বাংলার কাশী শিবনিবাস ঃ-
বাংলার ইতিহাস খ্যাত পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ স্থান শিবিবাস। নদীয়া জেলার এই শিবনিবাসকে বলা হয় বাংলার কাশী। কিন্তু কাশীর সাথে কোন মিল নেই। কাশীর মত গঙ্গা না থাকলেও আছে শিবনিবাসে চূর্ণী নদী। কাশীতে আছে গঙ্গার উপর শক্তপোক্ত লোহার ব্রীজ আর চূর্ণীর উপর বাঁশের নড়বড়ে সেতু। কাশীর সাথে মিল না থাকলেও ছড়ায় মিল যথেষ্ট।
"শিবনিবাস তুল্য কাশী ধন্য নদী কঙ্কনা
উপরে বাজে দেবঘড়ি নীচে বাজে ঠন্ঠনা
কৃষ্ণনগর রাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২-৬০) অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখলেন ঃ-
"---- কৃষ্ণচন্দ্র মতামান।
কাশীতে করিবে জ্ঞানবানী সমান।।
বিগ্রহ ব্রহ্মণ্যদেব মূর্তি প্রকাশিয়া।
নিবাস করিবে শিবনিবাস করিয়া।।"
এই শিবনিবাসে নুশরত খাঁ নামে একজন দুর্ধর্ষ কুখ্যাত ডাকাত বাস করত।
মারাঠী বর্গী আক্রমণে থেকে পরিত্রাণ ও আত্মরক্ষার জন্য দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্রের পরামর্শ মত চূর্ণীর দ্বারা " কঙ্কণের আকারে পরিবষ্টিত " এই শিবনিবাসে কৃষ্ণচন্দ্র রাজপ্রাসাদ ও শিবমন্দির নির্মাণ করেন। নদীয়া রাজ্যের রাজধানী হল শিবনিবাস। তবে রাজীবলোচন তার গ্রন্থে লিখেছিলেন মহারাজা মৃগয়া করতে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শিবনিবাসে রাজধানী স্থাপন করেন।
কৃষ্ণচন্দ্র ১০৮ টি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। বর্তমান ৫ টি মন্দির অবশিষ্ট আছে, তবে তিনটি মন্দির একই জায়গায়। বড় শিব মন্দিরটি পূর্ব ভারতে এত বড় শিবলিঙ্গ নেই বলা চলে। মন্দিরটি বুড়ো শিব মন্দির নামে পরিচিত উচ্চতা ১২০ ফুট, খাড়া দেওয়ালের প্রতি কোনে মিনার ধরনের আটটি খিলান আছে । কালো শিব লিঙ্গটির উচ্চতা ৯ ফুট আর বেড় ২১ ফুট ১০ ইঞ্চি। এই সুবৃহৎ শিবলিঙ্গটির সাবেক নাম 'রাজরজেশ্বর'। মাঘ মাসে ভীম একাদশীতে মেলা হয় চলে শিবরাত অবধী।
মন্দিরের পূর্ব দিকে ৬০ ফুট উচু একটি মন্দির দেখতে পাবেন। মহারাজের দ্বিতীয় মহিষী প্রতিষ্ঠিত 'রাজ্ঞীশ্বর' মন্দিরে ৭ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন শিবলিঙ্গ আছে। দুটি মন্দিরই তৈরী হয়েছিল ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দে।
আরো একটা রাম সীতার মন্দির পূর্ব দিকে রয়েছে। পশ্চিম মুখি চার চালার ৫০ ফুট উুঁচু মন্দির। শিখরে ৪ টি আলংকারিক মিনার রেয়েছ। মূল দালানের ৫ টি খিলান। গর্ভগৃহে ৩ টি খিলানে রয়েছে স্থাপত্যের নিদর্শন। গর্ভগৃহের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত কালো পাথরের রামচন্দ্র, অষ্ট ধাতুর দেবী সীতা অনুজ লক্ষণ। এছাড়া শিব, কালী, গণেশ, সরস্বতীর প্রাচীন মূর্তি। সেন যূগের বিষ্ণু মুর্তি রয়েছে। রাম সীতার মন্দিরটি তৈরী হয় ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে।
১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বিশপ রেভারেন্ট হেয়ার জলপথে ঢাকা যাওয়ার পথে শিবনিবাশের মন্দির ও রাজ প্রাসাদ দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রকাশিত গন্থে লিখলেন, " শিবনিবাসের মন্দিরগুলি সুরম্য ও অতি উত্তম স্থাপত্যের নিদর্শন। তিনি গথিক রীতির সুউচ্চ প্রবেশদ্বারটিকে ক্রেমলিনের প্রধান তোরণের সাথে তুলনা করেন।" বলেন, " এই বিস্তির্ণ প্রাসাদের নির্মণ শৈলী তাঁকে কনওয়ে ক্যাসেল ও বোলটন আবিবের কথা মনে করিয়ে দেয়।
শিবনিবাসের পাশের গ্রাম কৃষ্ণপুর, পাশে চূর্ণী। এই কৃষ্ণপুরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেনাবাহিনীর মামুদ জাফরের মাজার।
ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখলেন
" সেপাহীর জমাদার মামুদ জাফর
জগন্নাথ শিরোপা করিলা যার পর।"
প্রতি বছর এই মাজারে ফাল্গুন মাসের শুক্লা পক্ষের বৃহস্পতিবারে বিরাট মেলা বসে। হিন্দু-মুসলমান মিলনমেলা বলা যায়।
লোকসংস্কৃতির দিক থেকে শিবনিবাস ও তার আশেপাশের গ্রামগুলির নাম জগত বিখ্যাৎ জেলার আদি উৎসব বলতে বোলান গানকে বোঝায়। কৃষ্ণপুরে আছে বোলানের অনেক শিল্পীরা। বোলান আদতে শিব গাজন। সারা চৈত্রমাস জুড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই বোলান পরিবেশিত হয়।
কীভাবে পৌঁছাবেনঃ--
শিয়ালদহ থেকে গেদে প্যাসেঞ্জারে মাজদিয়া স্টেশনে নেমে পশ্চিমে স্ট্যান্ড থেকে পেয়ে যাবেন অটো বা টোটো ৯ কিমি গেলেই শিবনিবাস। নতুন ব্রীজ দিয়ে একবারে মন্দির প্রাঙ্গণে পোঁছানো যাবে। রাত কাটাবার কোন প্রয়োজন নেই একদিনের ভ্রমণই যথেষ্ট।
0 মন্তব্যসমূহ