মংপু ঘুরে আসি চলুন--
শিলিগুড়ির বিশাল সিনেমা হলের পাশ থেকে লাটপঞ্চারের যাওয়ার জন্য ট্রেকার ছাড়ে। কালিঝরা হয়ে খাড়া চড়াই পেরিয়ে সুন্দর একটি পাহাড়ি গ্রাম লাটাপাঞ্চারে পৌঁছে দু-চোখ ভরে দেখে নিন পাহাড়ের প্রাকৃতিক শোভা। তবে এপথে ট্রেকার আর ছোট বাস ছাড়া আর কিছু পাওয়া খুবই সমস্যা। শিলিগুড়ির অনতিদূরে পানিট্যাঙ্কির মোড়ে এসে দেখলাম অসংখ্য জানবাহন, বাস, ট্রেকার, ইত্যাদি শুধু গাড়ির আড্ডা -দার্জ্জিলিং, গ্যাংটক, ফুন্টশিলিং, সামসিং, গরুবাথান, লাভাসহ আরো অনেক ডেস্টিনেশানে গাড়ি ছুটছে অনবরত।
একটা ছোটগাড়ি ভাড়া করে রওনা হলাম লাটাপাঞ্চরের উদ্দেশ্য। আমাদের অ্যাম্বাসাডরটা কমলা রঙের এবং নতুন। গাড়ি শহর ছাড়িয়ে হু হু করে ছুটলো। আমরা মহানন্দার অভয়ারণ্যের ঋজু শাল বৃক্ষের অপূর্ব ঘন বন পার হোতে ভালোই লাগছিল।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ কালো হয়ে এলো। ঝম ঝম করে অঝরে বৃষ্টি নেমে এলো, ড্রাইভার বল্লেন, এখানে এরকমই হয় এই বৃষ্টি এই রোদ্দুর। বর্ষায় গোটা পাঁচেক হনুমানগুলো ভিজতে দেখলাম।
সেবক রেলগেটের কাছে আসতেই বৃষ্টি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো, কেননা রেল পাস হবে এখন। এগিয়ে কাঁচা ভুট্টার পসারী। পাশেই উনুনে পোড়ান হচ্ছে কাঁচা ভুট্টা। শুনলাম বারো মাসই এই রেল গেটে আধপুড়া ভুট্টা বিক্রি হয়।
হুইসেল বাজিয়ে তিস্তা-তোর্ষা এক্সপ্রেস ছুটে গেলো। রেল গেট খুলে গেলো। আমরাও রওনা দিলাম। থামলাম একটু পাহাড়ের গায়ে একটি শিব মন্দির আর কালি মন্দির দেখবার জন্য। মন্দির দু-টি দেখে আবার রওনা হলাম। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে তুঁত জলের তরঙ্গিনী তিস্তার তিরে বেয়ে গাড়ি ছুটছে কালিঝোরার দিকে। রাস্তা মেরামতির কাজ চলছে, কাজেই গতি শ্লথ হলো কিছুটা। কাজ করছে ফুটফুটে ফর্সা ফুলের মত নেপালী মেয়েরা। রঙিন পোশাকে, দু-গালে ফুটে উঠেছিল রঙিন আভা। করোনশান ব্রীজ বা বাঘপুল অবধী কাজ চলছিল।
চলে এসেছি কালিঝোরায়। NHPC -র বিশাল জলবিদ্যুত কেন্দ্র রাম্বি-কালিঝোরায়। পুর্ত দপ্তরের বাংলো ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি। খানিকটা গিয়ে ডান দিকে মোচড় দিয়ে লাটাপঞ্চারের পথ পেলাম। এবারের রাস্তা মিললো আঁকাবাঁকা কর্দমাক্ত। খানিকটা গিয়ে গাড়ি হপিয়ে উঠলো। ড্রাইভার গাড়ির সাময়িক বিশ্রামের জন্য আমাদের কিছুটা হাঁটতে বল্লেন। নেমে হাঁটাহাঁটি করছি, একজন কৃষক ক্ষেতে কাজ করছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, লাটাপাঞ্চার কতদূর? কৃষকবন্ধুটি উত্তর করলো " যাবে তবে রাস্তা খুবই খাড়ই।"
শেষমেষ যাওয়া ক্যানসেল করা হলো। মনটা খরাপ হয়ে গেল। হতাশার মধ্যে ঠিক হলো আমরা মংপু যাবো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি।
সারিবদ্ধ পাহাড়ের গা ঘেঁসে তিস্তার পাড় ধরে মনোমুগ্ধকর শোভা দেখতে দেখতে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে চললাম রাম্বির দিকে। রাম্বিতে পাহাড় কেটে তিস্তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে জলবিদ্যুৎ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে অফিস, কোয়ার্টার, বাড়ি, হাট-বাজার, পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে উপনগরী।
রাম্বি থেকে বাঁ দিকের রাস্তায় মংপু। মূল সড়কটা চলে গেছে তিস্তাবাজার রংপো হয়ে
গ্যাংটকের দিকে। মংপুর রাস্তাটা খুবই সুন্দর। দেখতে দেখতে মংপুর কাছে চলে এলাম। রাস্তার পাশে সিঙ্কোনা গাছের সারি।
বন্ধ কারখানা, অফিস, দোকান-পাঠ নিয়ে মংপু শহর।
আমরা মূল সড়ক থেকে নেমে সোজা চললাম রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্যা মৈত্রেয়ি দেবীর বাড়ির সদর দরজায়। কেয়ারটেকার সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। ভিতরে ঢুকে অদ্ভৃত ভাললাগার আবেগে আপ্লূত। প্রায় ১৮০ ডিগ্রী সামনেটা বিস্তীর্ণ এবং খোলামেলা। আকাশ পরিস্কার থাকলে অপূর্ব পর্বত শৃঙ্গ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এই অপরূপ নৈশর্গের আকর্ষণে মাঝে মধ্যে এখানে এসে থাকতেন। বাড়িটা সংগ্রহশালা হিসাবে রক্ষিত। নেপালি কেয়ারটেকারের সৌজন্যে সংগ্রহশালার ভিতরে প্রবেশ করলাম। তিনি অনর্গল বাংলায় কথা বলছেন। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা তিনি আবৃত্তি করে চলেছেন। সংগ্রহশালায় সংগৃহিত পান্ডুলিপি, চিঠিপত্র, বাসন, চেয়ার, জিনিসপত্রের সবিস্তর বিবরণ শোনালেন। রবীন্দ্রনাথ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় বিশ্বাসী ছিলেন। এসব দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এখনও তিনি এক ঝুলন্ত বাগান, বিশেষত তাঁর প্রিয় ফুল ক্যামেলিয়াগুচ্ছের পাশে বসে দূর দিগন্তের পর্বতশীর্ষের দিকে তাকিয়ে লিখে চলেছেন ' কথা ও কাহিনী ' এককালের মংপু আজ যেন বড়ই ক্ষয়িষ্ণু। তবু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যেন অপরিসীম।
======
কী ভাবে যাবন :- কলকাতা থেকে যে কোন ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি, এখান থেকে ট্রেকারে মংপু।
থাকার যায়গা;- মংপু গেষ্ট হাউস অনবদ্য।
0 মন্তব্যসমূহ