মামা-ভাগ্নে পাহাড় বীরভূমের বিস্ময় ঃ-
বীরভূমের এক ছোট্ট শহর দুবরাজপুর। রাঢ় বঙ্গের অংশ। প্রকৃতি এখানে এবড়ো থেবড়ো হলেও চাষাবাদ করার জন্য সমতল ভূমিও আছে। দুবরাজপুর স্টেশন থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করলেই যাওয়া যায় অনায়েসে। দূর থেকে মনে হয় যেন সমতল ভূমির উপর হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠেছে পাহাড় । গাড়ি এই পর্যন্ত, হেঁটে মামা-ভাগ্নের কাছে যেতে হবে। এই পাহাড়ে সব চেয়ে মনগ্রাহি মন্দির হচ্ছে পাহাড়েশ্বর মন্দির। পাহাড়ের ঢালে এই স্বেত মন্দিরের নিপুন কারুকার্য পাহাড়ের চৃড়ার মত উঁচু চূড়া যে কোন মানুষকে মোহিত করবে। কহবত এই যে ষোড়শ শতাব্দিতে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। কালী পূজা হয়। মাটির মূর্তি ১২ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন। বিগ্রহ বিবসনা, পায়ের নীচে শুয়ে আছে মহাদেব। প্রথা অনুযায়ী দুর্গাত্রয়োদশীতে মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হয়। কালী পুজোর দিন থেকে সারা বছর পুজো হয়। দুর্গা একাদশীতে মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়। কথিত আছে স্থানীয় হরিজনরা কালী মূর্তিকে গালিগালাজ না করলে মূর্তি বিসর্জন হয় না। মন্দিরের ভিতরে পাহাড়ের ২ টি শীলাকে শিব ও পার্ব্বতিরূপে পুজো করা হয়। পাশে হুনুমান মন্দির। প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গ্রানাইট পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। হুনুমান মন্দিরের পাশ দিয়ে ছোট বেশ কটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলেই ঢালাই এবং মসৃন রাস্তা দেখা যাবে। সারা রাস্তা জুড়ে আছে উঁচু উঁচু বৃক্ষরাজি। ফুরফুরে মৃদুমন্দ বাতাস বহিছে। দু'পাশেই অনেকগুলি টিলা। কারা যেন ইন্জিনিয়ারিং কায়দায় সাজিয়ে তুলেছে। নিখুঁত সজ্জারীতি মেনে বোল্ডারগুলো দাঁড়িয়ে আছে, এক অদ্ভূত ভারসম্য নিয়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভূমিকম্প এদেরকে টলাতে পারেনি। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সব মিলিয়ে এক অদ্ভূত মায়া জাল । এই মায়াবী পরিবেশ থেকে বাংলার অন্যান্য পাহাড় চেয়ে মামা ভাগ্নে পাহাড়কে আলাদা করা অবশ্যই যায়।
একদম এক পাশে ছোট একটি গুম্ফা। স্থানীয়রা এটাকে গুম্ফাঘর বলে। কেউ কেউ রাজ প্রাসাদ বলে। এর সামনে মৌনি বাবার পাহাড়েশ্বরী মন্দির। এই পাহাড়ের আকর্ষণীয় যোনি পীঠ। ছোট বড় পাথর দিয়ে গড়ে ওঠা এক প্রাকৃতিক বেদি। পাশে কংক্রটের কালি মন্দির। স্থানীয় মানুষেরা মা শ্যামাঙ্গি নামে পৃজা করে আসছেন। বেদীর আর এক পাশে এক প্রাকৃতিক যোনি চিহ্ন, যা নাকি স্বয়ং মা কামাক্ষা। প্রাকৃতিক যোনি চিহ্নের উপর ২ টি পাথর সামান্য পার্থক্য রেখে গলা জড়া জড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে।
একটি পাথর ১৫ ফুট উঁচু আর একটি ১২ ফুট। বড়টি মামা ছোটটি ভাগ্নে। ছোট নাগপুর মালভূমির অগ্রিম ভাগে কোন পাহাড় নেই। মিথ আনুযায়ী সিঁদুর মাখা বিরাট পাহাড়েশ্বর মন্দিরে নিয়মিত পুজো হয়। বিজ্ঞান বলে এখানে লাল মাটির আধিক্য থাকার ফলে এক সময় এখানে সেই সব পাহাড় মাটির সাথে মিশে গেছে। শুধু দুবরাজপুর ব্যতিক্রম।
উটের কুঁজের মত পাহাড় ছিল। ছোট নাগপুরের আসেপাশে কোথাও পাহাড় নেই।
এক সময় জঙ্গল দুবরাজপুর বলে সবাই চিনতো। এখন পৌর দুবরাজপুর নামে সবাই চেনে। ২০০০ সাল থেকে পাহাড়েশ্বর সৌন্দর্য্যায়ণের কাজ শুরু হয়। মন্দির লাগোয়া ১ টি চিল্ডেন পার্খ তৈরি হয়। ২০০৩ সালে পার্কটি আরো বড় করা হয়। শীতকালে পিকনিক পার্টি ভরে যায়।
কীভাবে পৌঁছাবেন ঃ- হাওড়া, শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে বোলপুর। বোলপুর থেকে ভাড়া গাড়িতে অথবা নিজস্ব গাড়িতে মাত্র ৪৫ মিনিট জার্নি করে চলে আসুন মামা ভাগ্নে পাহাড়ে।
কলকাতা থেকে রামপুরহাট অথবা তারপীঠ স্টেশনে নেমে দুবরাজপুর ট্রেনে দুবরাজপুর আসুন, এখান থেকে অটো বা বাসে ৫/১০ মিনিটের জার্নি করলেই মামা ভাগ্নে পাহাড়ে পৌঁছনো যাবে।
কোথায় থাকা যাবে ঃ- কাছাকাছি বক্রেশ্বর, দুবরাজপুর, শান্তিনিকেতন, সিউড়িতে প্রচুর হোটেল সাধ্য মত খরচে পেয়ে যাবেন। তাছাড়া মামা ভাগ্নে পাহাড়ের কাছে একটি ধর্মশালা আছে, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
কখন যাওয়া যায় ঃ- এমনিতে বীরভূমে খুব গরম আবার শীতে খুবই ঠান্ডা, তাই বসন্ত, হেমন্ত সঠিক সময়। হেমন্তে এখানে হাল্কা শীতের আমেজও পাবেন।
0 মন্তব্যসমূহ