ভারতবর্ষের একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ , এই রাজ্যের একটি বিখ্যাত জেলা হল নদীয়া জেলা । আর নদিয়া জেলার অতি প্রাচীন শহরগুলির মধ্যে অন্যতম শান্তিপুর । তাঁত শিল্প ও শাড়ী শিল্পের জন্য জগত জুড়ে নাম এই স্থানের । একসময় বাংলার অক্সফোর্ড অর্থাৎ নদীয়া জেলার নবদ্বীপের পরেই ছিল শান্তিপুরের নাম । শিক্ষা দিক্ষা , সংস্কৃতিতে এখনও বহু ভাবে এগিয়ে চৈতন্য প্রভুর পদধুলিতে ধন্য এই শান্তিপুর শহর । আজ আলোচনা করবো শান্তিপুরের শান্তিপুরের শ্যামচাঁদ মন্দির ও বাবলা পাট ও রাস উৎসব সম্বন্ধে ।
শান্তিপুরের শ্যামচাঁদ পাড়ায় এই মন্দিরটি অবস্থিত।এই মন্দির বঙ্গদেশের ইষ্টক দ্বারা রচিত মন্দিেরর মধ্যে অন্যতম। ইহার গঠন শৈলি অতীব সুন্দর। এর বহির্বিভাগ দ্বিতল সমৃদ্ধ। সামনের দিক সুকারুকার্যময়। সুউচ্চ চূড়াদেশে ত্রিশূল এবং ধাতু নির্মিত পতকা দেখা যায়। প্রয়াত গোপাল খাঁ চৌধুরীরা ১৬৬৪ শকাব্দে প্রয়াত রাধেশ্যাম চাঁদ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবত ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে শ্যামচাঁদের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। কথিত আছে মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় যে মহাযজ্ঞ হয় তাতে কাশী, কাঞ্চি, দ্রাবিড়, মথুরা, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ প্রভৃতি স্থান থেকে পন্ডিতগণ আসেন এবং তৎকালীন সময়ে ৮/৯ লক্ষ মুদ্রা খরচ হয়। মন্দির তৈরীতে খরচ হয় তৎকালীন দুই-তিন লক্ষ টাকা যার বর্তমান মুল্য করা খুব কঠিন ।
মন্দিরের অভ্যন্তরে স্থিত অপরূপ সুন্দর মণিময় শ্যামচাঁদ বিগ্রহকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নামে এবং স্বর্ণময়ী রাধিকা মূর্তিকে গুরু রাধাবল্লভ গোস্বামী বাচস্পতির নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দিরটি আটচালা, উচ্চতা-১১০ ফুট দৈর্ঘে এবং প্রস্থে -৬৮ ফুট। এই মন্দিরটি উচ্চ পাদপীঠের উপর অবস্থিত। মন্দিরে ফলকে লিখিত ঃ
"শ্রীমাঃ শ্যামচন্দ্রস্য মন্দির-তাসিয়াৎ।
বসুদেবতু শুদ্রাংশু সংখ্যায় গণিত শকে।"
শান্তিপুরের আরেক নিদর্শন বাবলা পাট । এই বাবলা পাট শান্তিপুরের তথা সারা ভারতের এক প্রসিদ্ধ স্থান । এখানে শতাব্দি প্রাচীন একটি মৃত্তিকা , একটি সুপ্রাচীন স্তুপ, শান্তমুণির পাট বলে গণ্য হতো, এই মৃত্তিকাস্তুপই বাবলা পাট। আপনারা অনেকেই স্বামী পরমহংস য়োগানন্দের নাম শুনেছেন - তাঁর গুরুদেব শ্রী জোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের জন্ম এই নদীয়াতেই , সেই বিখ্যাত সাধক শ্যামাচরণ লাহিড়ী, মহেন্দ্রনাথ বিশ্বাস প্রমুখ ব্যক্তি ঐ স্থানে কুটির নির্মাণ করে কীর্ত্তনাদি করতেন। কথিত আছে অদ্বৈতাচার্য্যের স্বপ্নাদেশে তারা ঘোড়ালে হতে নিমবৃক্ষ আনিয়ে তা দিয়ে শান্তিমুণি আচার্য্যের যৌবনকালের মূর্ত্তি নির্মাণ করে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। আধাত্মভাব না থাকলে এই স্থানের মাহাত্ম্য বোঝা মুশকিল ।
শান্তিপুরের রাস উৎসব ঃ--
১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে শান্তিপুরের রাস উৎসবের সুচনা হয় বলে অনেকেই মনে করেন। বাড়ির অপরূপা বালিকাকে রাইরাজা সাজিয়ে হাওদা করে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। কার্ত্তিক পূর্ণিমার রাতে শুরু হয় পূজা, পরের দিন মাঝের রাস। আর তারপরের দিন সন্ধ্যায় শুরু হয় শোভাযাত্রা। এই রাস ভাঙা রাস নামে খ্যাত। শোভাযাত্রার প্রথমে থাকে বড় গোস্বামী বাড়ির পূজা।পরে বিভিন্ন বাড়ীর পূজা। রাইরাজা বা রাধিকারাজার শোভাযাত্রা, আলোর ঝলকানি, লোকশিল্পীদের নৃত্য, ব্যান্ড বিভিন্ন বাদ্য এরং ট্যাবলো। লাখো মানুষের ভীড়ে উত্তাল হয়ে পড়ে শান্তিপুরের আকাশ-বাতাস।
একনজরে শান্তিপুরের দর্শনীয় স্থানঃ-
১) বাবলায় অদ্বৈত্যাচার্য্যের সাধন পীঠ।
২) ফুলিয়ায় মহাকবি কৃত্তিবাস স্মৃতিস্তম্ভ।
৩) সাধক বিজয়কৃষ্ণের বাড়ি।
৪) উচ্চ শ্যামচাঁদ মন্দির।
৫) শান্তমণি প্রতিষ্ঠিত বুড়ো শিব মন্দির।
৬) আগমেশ্বরী মন্দির।
৭) জলেশ্বর মন্দির।
৮) তোপখানা মসজিদ।
৯) সরিফা মসজিদ।
১০) আশানন্দ ঢেঁকির স্মৃতিমন্দির।
১১) বাগ আঁচড়া বাগদেবীর মন্দির।
১২) শান্তির পুর সাহিত্য পরিষদ।
১৩) শান্তিপুর পুরাণ পরিষদ।
১৪) পাবলিক লাইব্রেরী।
১৫) কবি করুণানিধানের বাড়ি।
১৬) সাহিত্যিক রামপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি।
১৭) সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি।
১৮) সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির।
১৯) রাষ্ট্রিয় উদ্যান।
২০) যোগাচার্য্য শ্যামসুন্দর গোস্বামীর জন্মভিটা।
কীভাবে পৌঁছাবেনঃ- শিয়ালদহ থেকে শান্তিপুর লোকালে শান্তিপুর। টোটো চুক্তি ভিত্তিক ভাড়া করে সবস্থান ঘুরে নেওয়া ভালো।
0 মন্তব্যসমূহ