সিকিমের ইয়াকসাম
সপ্তদশ শতাব্দির মাঝামাঝি লামা লুটসাম চেম্ব ভেনজংয়ের ( অধুনা সিকিম) উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্যে ছিল দক্ষিণের ধান-উপত্যকায় বৌদ্ধ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। দীর্ঘ যাত্রার পর ১৬৪১ সালে তিনি নরবুরাং নামে একটি জায়গায় পৌঁছান। সেখানে আর দুই লামা সেম্ব চেম্বো এবং রিমঝিম চেম্বোর সঙ্গে তার দেখা হয়।
তিন লামা মিলে এক শক্তিশালী রাজার খোঁজ শুরু করেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অধুনা গ্যাংটকের কাছে ফুসকো নামে সুযোগ্য ব্যক্তির খোঁজ পায়। ফুসকো ছিলেন সিকিমের ধর্মগুরু তাসিমের বড় নাতি।
ফুসকোকে নরবুগাংয়ে নিয়ে আসা হয়। তিন লামার উপস্থিতিতে তাঁর রাজ্যাভিষেক ঘটে। ফুসকোকে চগিয়াল উপাধি দেওয়া হয়। এবং তিনি চগিয়াল ফুসকো নাম গিয়াল নাম নিয়ে সিকিমের প্রথম রাজার দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে যে পাথরের সিংহাসনে ফুসকোর রাজ অভিষেক হয় সেই সিংহাসনটি আজও মানুষ জন দেখতে পান। ঐতিহাসিক এই সিংহাসনটি নরবুগাংয়ের সিংহাসন নামে পরিচিত এবং আর্কিয়লজি সার্ভে অব ইন্ডিয়া( A S I) -এর তত্বাবধানে আছে।
নরবুগাংয়ের নতুন নাম করণ হয় ইয়াকসাম, য়ার অর্থ তিন লামার মিলনস্থল। বর্তমানে সময়ে ইয়াকসাম সিকিমের একটা গুরুত্ব পূর্ণ স্থান এবং নাম করা পর্যটন কেন্দ্র। এখান থেকে শুরু হয় সিকিমের ট্রেক রুট জোংরি - গোয়েচালা ট্রেক। তবে ট্রেকাররা ছাড়া ইয়াকসামে সাধারণ মানুষ বা পর্যটকদের আনাগোনা প্রায় নেই বল্লেই চলে।
পশ্চিম সিকিম জেলার উত্তর - পশ্চিম প্রান্তে ইয়াকসাম। শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে জোরথাং হয়ে এখানে পৌঁছতে সময় লাগে ৬ ঘন্টা মত। ইয়াকসামে পৌঁছাবার সাথে সাথে ছেঁকে ধরবে ট্রেকিং এজেন্টরা। থাকবার জন্য তাঁবু থেকে গাইড, মাল বাহক থেকে ট্রেক পথে যা রসদ লাগবে সবই পাওয়া যাবে তাদের কাছে। ইয়াকসামের দুধারে আছে অনেক হোটেল। আছে ছোট বড় অনেক ট্রেকিং অফিস। এরা এজেন্ট হিসাবে কাজ করে।
সুন্দর সাজানো গোছানো গ্রাম হচ্ছে ইয়াকসাম। চারিদিক উঁচু পাহাড়ে ঘেরা। সবুজ পাহাড়ের উপর দিয়ে দেখা যায় বরফাকৃত কাব্রু শৃঙ্গ। তবে, ইয়াকসামা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া যায় না। রাস্তার দু'ধারে শুধু চোখে পড়ে বাতাসে উড়তে থাকা বৌদ্ধ প্রার্থনা পতকা। আর দেখা যাবে বৌদ্ধ প্রার্থনা গৃহ, বৌদ্ধ চক্র।
হেয়ার পিন বাঁক ছেড়ে এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে জোংরি গোয়েচলা ট্রেক রুট শুরু হওয়ার জায়গাটি। মাঝ রাস্তায় একটা স্তুপ পার হয়ে এগিয়ে গেলে বাঁ দিকে চোখে পড়বে A S I এর নীল বোর্ড, তির চিহ্ন দিয়ে নরবুগাংয়ের সিংহাসন দর্শনে যাওয়ার দিক নির্দেশ। পাথর ফেলা রাস্তা দিয়ে এগুলেই দেখা যাবে ঐতিহাসিক সিংহাসনের কাছে। পুরো পথটাই গাড়িতে আসা যায় তবে পাহাড়ের হাঁটা হাঁটি খুবই চমকপ্রদ। হাঁটতে খুব একটা সময় লাগবে বড় জোর ২০ মিনিট মত। সিংহাসনের এলাকাটি বেড়া দিয়ে ঘেরা। প্রবেশ মূল্য মাত্র ২০ টাকা মাত্র। আঁকাবাঁকা সিঁড়ি পথে চলে আসা যাবে সিংহাসনের সামনে। কিন্তু কোথায় সিংহাসন দেখা যাবে একটি পাথরের বেদি। প্রথম দর্শনে হতাশ হতে হবে। আজ থেকে ৫০০ বছর আগে এই পাথরের উপর সিকিমের প্রথম রাজার অভিষেক হয়। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
১৬৪১ সালে রাজ্য অভিষেক হয়ছিল এক পাইন গাছের নীচে। সেই পাইন গাছটি ৫০০ বছর ধরে আগলে রেখেছে।
ইয়াকসামের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক স্থানটি হল দুবদি গুম্ফা। এখানে যেতে হলে হাঁটা ছাড়া কোন গতি নেই। হাঁটা পথে আঁকাবাঁকা পথের শেষে মিলবে একটি পাহাড়ি নদী, কাঠের সাঁকো পার হয়ে গুম্ফাতে পৌঁছানো যাবে। ১৭০১ সালে গুম্ফাটি নির্মিত গুম্ফাটি খুব সুন্দর সাজানো গোছান। আছে ছোট ছোট বৌদ্ধ মন্দির। গুম্ফা প্রাঙ্গন থেকে ইয়াকাসাম গ্রামটির অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়।
কীভাবে পৌঁছাবেন ঃ- হাওড়া, শিয়ালদহ, কলকাতা স্টেশন থেকে নিউ জলপাইগুড়ি। এবার এখান থেকে পোলিং । পোলিং থেকে ইয়াকসম। আবার NGP থেকে জোরাথাং, জোরাথাং থেকে ইয়াকসম।
থাকবার জায়গা ঃ লিম্বো হোমস্টে, লভিসম হোমস্টে, ছুংগদা হোমস্টে, হোটেল তাসিগাং, হোটেল ইয়াকসুম রেসিডেনস।
0 মন্তব্যসমূহ