মুর্শিদাবাদের প্রধান নদী ভাগিরথী। নদীর পুব পাড়ে লালবাগ, যেখানে ছড়িয়ে আছে নবাব আমলের নানা স্থাপত্য আর পশ্চিম পাড়ে জৌলুসহীন খোসবাগ।
মুর্শিদাবাদের চিত্রশিল্প, কাঁসাশিল্প, রেশমশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। তবু মুর্শিদাবাদ এখনো নবাবের দেশ নামে আপন গৌরবে গৌরাবন্বিত। যে নবাব পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হবার পরেও মানুষের মনে কিন্তূ চির স্থায়িত্বের আসন পেয়েছেন, তিনি হচ্ছেন নবাব সিরাজ উদ দৌলাহ।
সেকালের মুর্শিদাবাদ এখন লালবাগ শহর। প্রেম, বিরহ, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিহিংসা, খুন আর প্রিয়জনদের কবরে চিরাগ জ্বালিয়ে স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকার নাম হচ্ছে খোসবাগ। মুর্শিদাবাদ স্টেশন থেকে লালবাগ, এ বার নৌকায় ভাগিরথী পার আবার টোটোয় পৌঁছাতে হবে খোশবাগ। দু-পাশে সব্জীর ক্ষেত মন ভরিয়ে দেবে। "খোস" শব্দের অর্থ খুশী আর "বাগ" মানে বাগান বা বাগিচা। এখন এই স্থান ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ সযত্নে সংরক্ষণ করেছে।
এখানকার সব কবরই নাম গোত্রহীন।
১৭৪০ সালে সিংহাসনে বসার পর নবাব আলিবর্দি খাঁ খোসবাগ গড়ে তোলেন। ভাগিরথী পেরিয়ে সপরিবারে মনোরঞ্জনের জন্য খোসবাগে আসতেন। ভাগিরথীর ওপারে ঘসেটি বেগম থাকতেন। এখান থেকে যাতে সরাসরি ঘসেটির প্রাসাদ দেখার জন্য সোজসুজি দুয়ার তৈরি করেন, যাতে দেখা যায়।
শোনা যায় ১০৮ রকমের গোলাপের চাষ হোত এই খোশবাগ চত্বরে। সেই গোলাপের খুসবু বা গন্ধ থেকে খোশবাগের নাম করণ। ৭.৬৫ একর জুড়ে বিরাট সমাধি এলাকা। নবাব আলিবর্দি খানের অন্তিম ইচ্ছা ছিল, তিনি যেখানেই মারা যান, তাঁর মৃতদেহ যেন এই খোশবাগে সমাহিত করা হয়। অনেক বিদগ্ধ জনের মতে ১৭৫৬ সালে আলিবর্দি খাঁ মারা যাবার পর এই খোশবাগে সমাধিস্থ করা হয়। খোশবাগে আলিবর্দির সমাধিই প্রথম।
দরাজার পাশের প্রথম সমাধিটা আলিবর্দির স্ত্রী সরিফুনিসা বেগমের। এইখিনের দক্ষিণ প্রান্তে আরো দু-টি সমাধি দেখা যাবে পাশাপাশি দুটি কবর একটা সিরাজের মা আমিনা বেগম, আর একটা সিরাজের খালা বা মাসি ঘেসেটি বেগম। লোকমুখের কাহিনী মোতাবেগ জানা যায় মিরজাফরের ছেলে মিরণ নৌকা যোগে দুই মহিলাকে ভাগিরথীতে ফেলে দেওয়া হয়। ঘসেটি বেগম বাঁচার ইচ্ছেয় হাতল আকড়ে ধরে, হাত কেটে নেওয়া হয় এবং দুজন রমণীর সলিল সমাধি হয়ে যায়। এ কাটা হাতের সমাধী দেওয়া হয়। ঐ সমাধীস্থল উুঁচু প্রাচির দিয়ে ঘেরা।
এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে ১৭ জনের কবর। কথিত আছে, সিরাজ যখন বন্দি, ঢাকা, মুঙ্গের, বিহার থেকে সিরাজের আত্মীয় সজন দেখতে আসেন। মীরাজাফরের পুত্র মিরণ প্রত্যককে বিষ খাইয়ে খুন করে। তাঁদের সমাধীক্ষেত্র। তাঁদের মধ্যে অনেক মহিলা ও শিশুরাও ছিল। আরবি ও ফরাসি ভাষায় লিখিত দুটি লিপি দেখা যাবে। পশ্চিম দিকে দানেশ ফকির তার স্ত্রী ও মেয়ের কবর।
নামাজ আদায়ের সময় মিরণের নির্দেশে সিরাজকে খুন করা হয়। তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে হাতির পিঠে চাপিয়ে সারা মুর্শিদাবাদ ঘোরান হয়। পরে সিরিজের আত্মীয় সজনরা সিরাজের টুকরো দেহ নিয়ে খোসবাগে সমাধীস্থ করে। সিরাজের ৬ বছরের কন্যা উন্মতজহুরাকে মিরণ জলে ডুবিয়ে খুন করে। তাঁর সমাধীটি আছে।
সিরাজের কবরের নীচে দক্ষিণ পূর্বে ২ টি বিতর্কিত কবর আছে। ১ টা সিরাজের স্ত্রী লুৎফউনেসা বেগম আর আলিবর্দির ও মোহনলালের কন্যা নর্তৃকী সিরাজের খুবই প্রিয় আলেয়ার কবর।
হাতে সময় নিয়ে খোশবাগ দেখতে হবে। কাছেই কিরিটকণা গ্রাম। এখানে মা কিরিটিশ্বরী মন্দির দেখি যাবে। সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম পীঠ এটি। দক্ষ যজ্ঞর পর প্রলয় নাচনের সময় বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহচ্ছের সময় মায়ের কীরাট বা মুকুট এখানে পড়ে। নাটোরের রাণী মা ভবানী এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন বলে সবাই মনে করেন। যদিও মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন পাশে কীরিটিশ্বরী নামে গড়ে উঠেছে দেবালয়। দেবলয়টি হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান স্থাপত্যের ছাপ পওয়া যায়।
কীভাবে যাবেন ঃ- শিয়ালদহ অথবা কলকাতা স্টেশন থেকে লালগোলা ট্রেনে লালবাগ। ভাগিরথী পার হয়ে খোশবাগ।
0 মন্তব্যসমূহ