Header Ads Widget

Responsive Advertisement

ঘাটশিলা ঘুরতে যাবেন ? জেনে নিন ঘাটশিলা ভ্রমণের খুঁটিনাটি

ঘাটশিলা এখন কেমন আছে, দেখে আসি চলুন ঃ--



মনোরম ঘাটশিলাবিদ্যুৎ চলে গিয়েছে সন্ধ্যা নামতে না নামতেই। কখন আসবে বা রাতে আদৌ আসবে কি না, তার গ্যারান্টি নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে, এবড়ো-খেবড়ো ‘অপুর পথ’, মানে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ‘গৌরীকুঞ্জে’ যাওয়ার গলিরাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই হোটেলটার সামনে। আলো না থাকলেও বুঝতে অসুবিধে হল না, কলেবরে এখন বড় হয়েছে সেই হোটেল।  ‘হোটেল আনন্দিতা’ উঠে গিয়েছে এক যুগ আগে। ওই বাড়িটা আরও বাড়িয়ে তিন তলা করে তৈরি হয়েছে অন্য এক হোটেল।
পুরনো কর্মচারীদের মধ্যে একমাত্র কমলদা, রাঁধুনে কমল দাসকে নতুন মালিক নতুন হোটেল তৈরি করার পরেও ছাড়েননি। সত্তরোর্ধ্ব কমলদা হোটেলের বাইরেই দাঁড়িয়ে। চিনতে না পারারই কথা। কিন্তু আনন্দিতা হোটেলের বহুকালের পুরনো বোর্ডার শুনে কমলদা সহজে আপন হলেন।  একদা ঘাটশিলার সেরা হোটেল কী ভাবে শেষ হয়ে গেল। 

ঋণে জর্জরিত মালিক হোটেল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন সাত বছর আগে। অকালমৃত্যু হয়েছে মালিকের একমাত্র ছেলের। ছিমছাম দোতলা ভবনে আন্তরিক পরিষেবা ও কমলদার রাঁধা ঘরোয়া স্বাদের খাবার-দাবারের দৌলতে জমজম করত আনন্দিতা হোটেল। আর হাতবদল ও নামবদল হয়ে কলেবরে বাড়লেও ওই বাড়িটায় আনন্দিতার আনন্দ নেই।
আনন্দিতা হোটেল, বলা ভাল, অস্তিত্বহীন আনন্দিতা হোটেল যেন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গোটা ঘাটশিলারই চরম অবক্ষয়ের নির্মম প্রতীক। যেখানে কেবল একটা উড়ালপুল দাঁড় করানো হয়েছে, কিন্তু পর্যটনের পরিকাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে কবেই। যেখানে যাতায়াতের ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু পর্যটকের সংখ্যা কমে গিয়েছে অনেকটাই।

সংস্কারের অভাবে সুবর্ণরেখা এখন নালা।
ফুলডুংরি।কমবে না-ই বা কেন?

একটি পর্যটনকেন্দ্র হওয়ার নিরিখে ঘাটশিলা এখন নিঃস্ব, রিক্ত। যত দিন গড়ায়, কোনও পর্যটনকেন্দ্রের পরিকাঠামো উন্নত হয়। আর সেখানে দিনকে দিন ঘাটশিলার পরিকাঠামোই ভেঙে পড়েছে। রাস্তাঘাট এতই ভাঙাচোরা যে গাড়ি চললে ধুলো থেকে হাঁচি-সর্দি-কাশি ঠেকানো মুশকিল। ঘাটশিলায় পর্যটনের প্রসারে উদ্যোগী ও ‘গৌরীকুঞ্জ উন্নয়ন সমিতি’-র সভাপতি তাপস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “ঘাটশিলার রাস্তা এখানকার পর্যটনের প্রসারে বড় বাধা।” জুন মাসে তাপসবাবুদের উদ্যোগে গৌরীকুঞ্জে বসেছে সৌরশক্তির আলো, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি। তার আগেই আমূল সংস্কার হয়েছে ওই বাড়ির, বিভূতিভূষণ যেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু পর্যটকেরাই যদি ঘাটশিলামুখী না হন, তা হলে কে দেখবে আলো ঝলমলে গৌরীকুঞ্জকে?

অথচ ঘাটশিলার মতো ‘পশ্চিমে’ এক সময়ে বাঙালি ফি বছর যেত স্বাস্থ্য ফেরাতে। যেমনটা যেত জোসিডি-মধুপুরে-দেওঘরে। সপ্তাহখানেক ঘাটশিলায় থেকে সেখানকার জল খেয়ে পেটরোগা বাঙালি বছরের বাকি সময়ের জন্য হজমশক্তি সঞ্চয় করে আসত। ঘাটশিলার জল এখনও খারাপ নয়, কিন্তু রাস্তার ধুলোর জন্য বাতাস ময়লা হয়ে গিয়েছে। আর সেই ভঙ্গুর পথে চলার মূল যান বলতে গেলে অটোরিকশা। গোটা অটোরিকশাই ভাড়া নিতে হবে। ফলে, অবধারিত টান পড়বে পকেটে। অথচ একদা ঘাটশিলায় ট্রেকারের কোনও অভাব ছিল না। অল্প খরচেই যাওয়া যেত কাছাকাছি জায়গাগুলোয়।

ঘাটশিলায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে জন্মেছিল ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’-র অভিযান পড়ে। বয়স তখন দশও নয়। ওই বয়সের ছেলের বোঝার মতো করে ঘাটশিলার যে অপূর্ব ছবি লেখক এঁকেছিলেন, তা মনে গেঁথে গিয়েছিল। সুবর্ণরেখা নদী, ফুলডুংরি টিলা, কপার মাইনস, বুরুডি জলাধার, ধারাগিরির নিসর্গ বর্ণনা তো ছিলই, সঙ্গে ছিল জিভে জল আনা রসমালাই-ল্যাংচা-লেডিকেনির কথা।

শেষমেশ ঘাটশিলা ভ্রমণের সেই স্বপ্ন পূরণ হল । ঘাটশিলার তখন রমরমা। গ্রীষ্মকালে মরসুম না হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকদের ভিড় হোটেলে হোটেলে। ঘাটশিলা মেইন রোডের যে দিকে রেল লাইন সমান্তরাল ভাবে গিয়েছে, তার অন্য দিকে সার দিয়ে ছিল হোটেলগুলো। জাপানি লজ, সাফারি, শালিমার, আনন্দিতা। রেল লাইনের অন্য দিকে, কলেজ রোডে ওয়েসিস। একটি আর একটির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। শুধু আনন্দিতা ছিল অন্য সবগুলোর চেয়ে একটু এগিয়ে। কলকাতার চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চৈতন্য ঘোষ সপরিবারে একটা সময়ে ফি বছর ঘাটশিলায় গিয়ে উঠতেন আনন্দিতায়। হোটেল থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে না উঠতেই হাঁকডাক করত সাইকেল রিকশা, ট্রেকার, অটোরিকশা। অপরিচিত বাঙালি পর্যটককে দেখে ঘাটশিলার অবাঙালি মানুষ এমন ভাবে হাসতেন, যেন কত দিনের পরিচিত।

বুরুডি জলাধার।
এখন সে সব অতীত। শালিমার হোটেল আর জাপানি লজ ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। আনন্দিতা উঠে গিয়ে মেরিডিয়ান। কলেবরে বড় কিন্তু আনন্দিতার গরিমার ছিটেফোঁটাও নেই। আনন্দিতায় বাতানুকূল যন্ত্র ছিল না। মেরিডিয়ান-এর মালিক সাধ করে ছ’টি কিনেছিলেন। যাতে পর্যটকদের উন্নত পরিষেবা দিতে পারেন। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যে সে সব খুলে ফেলে কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, পর্যটকেরা এসি চালাবেন কী, বিদ্যুৎই তো থাকে না!
ঝাড়খণ্ডের ওই জনপদে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। কখনও কখনও গোটা এক বেলা বিদ্যুৎহীন গোটা ঘাটশিলা। হোটেলে পর্যন্ত তখন জলের আকাল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে ক্লান্ত জেনারেটরকে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম দিতেই হয়। ওই সমস্যার কথাই বার বার বলছিলেন অমরেন্দ্র মিত্র। ঘাটশিলার মোটামুটি ভাল থাকার জায়গা, কাশিদা তল্লাটের সুহাসিতা রিসর্ট-এর অভিভাবক। অমরেন্দ্রবাবুর কথায়, “জেনারেটর চালাতে যে পরিমাণ ডিজেল খরচ হয়, তাতে হাজার টাকা ঘরভাড়া নিয়েও লাভ হয় না। ঘাটশিলার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ঠিক না হলে এখানে পর্যটনের প্রসার হওয়া অসম্ভব।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ