কুলডিহার জঙ্গলে নিভৃতে ভ্রমণ ঃ--
পিয়াশাল, মহানিম, শিশু গাছের পাতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে থাকা শীতের পড়ন্ত বেলার নরম রোদ কখনও কখনও ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে। আমার জলপাই-সবুজ রঙা ‘জাঙ্গল হ্যাট’-এর আড়াল সরিয়ে কখনও বা সে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে। ডান দিকে একটা শিশু গাছের প্রায় মগডালটা দুলে উঠল। একটা কালচে বার্গেন্ডি আর সাদায় ‘ইয়োলো অকারে’ মেশা রোমশ শরীর শূন্যে গা ভাসিয়ে বাঁ দিকের শালগাছের দিকে। আমার শরীরটা বাঁ পায়ের গোঁড়ালির ওপর ভর দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ডান থেকে বাঁ দিকে ঘুরল আর হাতের ক্যামেরার শাটার পড়তে লাগল, ‘র্যাপিড সাকসেশান’, সেভেন এফ পি এস। কয়েকটা টুকরো সময়, শালের বড় বড় পাতার আড়ালে ঢাকা পড়ল তার শরীর, ঘড়ি তখন বলছে রাত সাড়ে ৩টে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ষগাড়ি হাজির। মিনিট চল্লিশের মধ্যে চাঁদিপুরে হোটেল। একটা হাল্কা ঘুম শেষে সকালে স্নান আর জলখাবার। প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়া কুলডিহার জঙ্গলে, তখন বেলা
ওড়িশার বালাসোর জেলায় ‘কুলডিহা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচুয়ারি’। প্রায় ৩০০ বর্গ কিমি মাপের এই জঙ্গল নীলগিরি পাহাড়ের কোলে। এর অন্য দিকে সিমলিপাল। সুখুয়াপাতা আর গাগুয়া— এই দুই পাহাড় কুলডিহাকে সিমলিপাল থেকে আলাদা করেছে। সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র ১৬৯ মিটার উঁচুতে এই জঙ্গলের ‘ল্যান্ডস্কেপ’ চোখকে আরাম দেয়। ছোট ছোট চারটে পাহাড়, ৪২৩ থেকে ৬৮২ মিটারের মধ্যে যাদের উচ্চতা, অষ্টাপাহাড়, দেবগিরি, রাঙামাটিয়া আর কোলিয়া, এই ‘ল্যান্ডস্কেপ’কে একটা আলাদা রূপ দিয়েছে। বেশ কিছু ছোট নদী বয়ে গেছে কুলডিহা দিয়ে— অঙ্গনা, কমলা, বসুধার আর উসটাল। আছে দুই জলাধারও। চলতে থাকে জিপ। জঙ্গলের আলোছায়ায় নিজেকে লুকায় এক চিতল হরিণ। তার সোনা-হলুদ শরীরটা একটা ‘ব্রাশ ওয়ার্ক’-এর কাজ রেখে যায় জঙ্গলের ক্যানভাসে।
জঙ্গলের পথ ধরে গাড়ি। যতটা সম্ভব ধীরে। মাঝে মাঝেই ছাতার আর ব্রেনফিভারের ডাক । একটা বড় উইঢিপির পাশ কাটিয়ে, জঙ্গলের আবছায়ায় হঠাৎ আর একটা প্রচ্ছায়া। গাড়ি একটু পিছিয়ে আনতেই সজীব হল সেই প্রচ্ছায়া। ছোট একটা চোখ একটু অবাক হয়ে তাকালো আর ততোধিক ভয় পেয়ে দুদ্দাড় ছুট লাগালো জঙ্গলের অন্দরমহলে। একটা বাচ্চা হাতি। একটু পরেই তার ডাক শুনা গেল জঙ্গলের গভীর থেকে, নিশ্চয়ই দলের বড়দের ডাকছে ভয় পেয়ে।
বেলা বাড়ছে। জঙ্গলের মাঝে এখন যে জায়গাটায়, সেখানে কি আশ্চর্য এক প্রশান্তি। জিপ দাঁড়িয়েছিল যেখানে, সেখান থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে, পায়ে পায়ে চলে, ঝোপ সরিয়ে, মাথার ওপর ঝুলে থাকা উডস্পাইডারের বিছানো জাল বেয়ে তার ওঠানামা দেখতে দেখতে। সেখানে কুল কুল করে বয়ে চলা জলের স্রোতে সন্তুরের মৃদু ঝালা, গ্রানাইট পাথরের ভিজে গায়ে আয়রন আর সালফারের নকশা তোলা, পাথরের খাঁজে জমে থাকা ছোট জলে এক টুকরো আকাশ নীল হয়ে, বয়ে যাওয়া জলস্রোতের ধারে পাথরের গা ঘেঁষে ড্যানড্যালিয়ানদের শরীরী প্রেম, কেউ তাকে দেখে চোখ ঢাকবে না বরং দেখতে দেখতে চোখ বেয়ে গড়িয়ে আসবে দু’ ফোঁটা জল। ভালবাসাতেও তো কান্না পায়! কুলডিহার জঙ্গলে এমন বেশ কয়েকটা জলস্রোত আছে, কী যে ভাল লাগার। মনে হয় বেশ কিছুটা সময় চুপটি করে বসে থাকি সেখানে, মন চলুক মনভাসির টানে। কুলডিহার এই জলস্রোত আর জলাশয়ের আশপাশের জায়গাগুলো সেখানকার হাতিদের স্নান করার আর তাদের ভালবাসাবাসির জায়গাও বটে।
যোধাচুয়া-রিসিয়া-বালিয়ানাল-যোধাচুয়া। প্রায় ১৫ কিমি এই পথ ঘুরে আসার পর বিকালে যাওয়া হবে যোধাচুয়া-পুরোনোপানি (৯ কিমি) পথে। -কুলডিহা ও কুলডিহা-যোধাচুয়া, মোট ১৬ কিমি রাস্তা। দুপুর ১টা নাগাদ প্রথম দফা সাফারি শেষে গাড়ি ফিরল ফরেস্ট রেস্টহাউসে। দেখা এক ময়ূর। রোদ পড়ে ঝলকাচ্ছে তার ফিরোজ নীল রং। গলাটা লম্বা করে এগিয়ে দিল এক বার, তার পর ঘাড় ঘোরালো, অপূর্ব বিভঙ্গ, মাথার ওপর শিখি নড়ছে, বারই শাটার টিপেছি, হাওয়ায় ভর করে ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল সামনের জঙ্গলটায়। দুপুরের খাওয়া শেষে সামনের ‘সল্টপিট’টাকে ডান হাতে রেখে জঙ্গলের পথে । যত ভিতরে ততই জঙ্গল আর তার নিজস্ব শব্দ ঘিরে ধরছে । প্রায় মিনিট চল্লিশ হাঁটার পর একটা জায়গা, মনে হল যেন হাল্কা নূপুরের আওয়াজ। চোখও একটু পরে দেখি একটা শজারু খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে, তারই চলার শব্দ। ফ্রেম বন্দি হল সে-ও। আজ সারা দিন বেশ কিছু পাখিও ক্যামেরায় মুখ দেখিয়েছে— বসন্তবৌরি, বেনে বৌ, বাঁশপাতি, মাছরাঙা, হলুদ মাথা বুলবুল, এমনকী একটা ‘ব্রান আউল’ বা প্যাঁচাও।
সামনের ‘সল্টপিট’-এ কয়েকটা হরিণ, ইতস্তত। নজরে এল একটা প্যাঙ্গোলিন। বেশ কিছুটা দূরে একটা উইঢিবির গোড়ায় খাবার খুঁজছে। ধরে ফেললাম ক্যামেরায়। একটা জায়ান্ট স্কুইরাল শালগাছের মাথায়, যে ডালে বসে আছে, কালিদাসের মতো, সেই ডালটাই কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। নানা মুখ ভঙ্গিমায় ধরা দিল সেও। একটা হাতির দল নজরে এল, রাস্তা পার হচ্ছিল। কালকের সেই বাচ্চাটাও সঙ্গে আছে মনে হল। এ জঙ্গলে ‘হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার’ও দেখা যায়।
সামনের বড় রাস্তার প্রান্তে একটা ছোট গাউর-এর দল। কাছাকাছি আসতেই গাড়ির আওয়াজে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে নেমে গেল। মাটির রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে, কুলডিহার গ্রামের মেয়ে-বৌরা তাদের পোষা গরুদের নিয়ে ঘরে ফিরছে। গরুর পায়ের আঘাতে ধুলো উড়ছে। সে ধুলোয় পাটে বসতে যাওয়া সূর্যের হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসা ইমনের ছোঁয়া। গোধূলি, বড় মন কেমন করা। কুলডিহার অরণ্যের নিশ্বাস-প্রশ্বাসে লুকিয়ে থাকা সেই আরণ্যক অষ্টাদশীকে এই কনে দেখা আলোয় দেখা হয়ে উঠল না, জানা হল না তার অজানা সৌন্দর্যের কথা, বাকি রয়ে গেল।
কীভাবে যাবেন কুলডিহায় ঃ-
কাছের বিমানবন্দর: ভুবনেশ্বর (২৬০ কিমি)।
কাছের রেলস্টেশন: বালাসোর (৩১ কিমি)।
থাকার জায়গা: ফরেস্ট রেস্টহাউস, তাঁবু অথবা চাঁদিপুরে হোটেল।
0 মন্তব্যসমূহ