কালিজ ভ্যালির রামধনু জলপ্রপাত ঃ
একটি পাহাড়ি উপত্যকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে, নির্জনতায় মোড়া পরিবেশে লুকিয়ে আছে এমন এক জলপ্রপাত, মেঘ সরিয়ে রোদ উঠলেই যেখানে দেখা যায় রামধনু। স্থানীয় নাম ইন্দ্রানী ছাগো বা ইন্দ্রানী ফলস, তবে বেশি পরিচিত ‘রেনবো ফলস’ (Rainbow Falls) নামে। আর দার্জিলিং হিমালয়ের কোলে এই শান্ত, স্নিগ্ধ ও সৌন্দর্য্যময় পাহাড়ি উপত্যকাটির নাম ‘কালিজ ভ্যালি’ বা ‘রেনবো ভ্যালি।
শব্দময় নৈশব্দঃ
রেস্টুর্যান্টের লাগোয়া ঝুলন্ত বারান্দাটা দারুণ। চেয়ার নিয়ে বসে পাশের চা বাগানটাকে যেন স্পর্শ করা যায়। চা বাগানটি ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে খাদের দিকে। খাদের ওপারে সুউচ্চ সবুজ পাহাড়ের প্রাচীর। সেই পাহড়ের ঢালে আবার নানান গাছ গাছালি, সবুজ ঢালু মাঠ, বা দু একটি বাড়ি, অনেক দূরে। নিচে একফালি উপত্যকা। কটেজে ফিরে আসার পর আকাশ কালো হয়ে মেঘের জাল ঢেকে দিল চারিদিক। এ তো ‘মেঘ পিওনের দেশ’। ওপারের পাহাড় গুলো আবছা হয়ে এল। শুরু হল বৃষ্টি। ঘরে শুয়ে চা বাগানে বৃষ্টি পড়া দেখতে বেশ লাগছিল। বৃষ্টি থামলে বিকেলের দিকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম গাড়ির রাস্তায়। কোন নতুন জায়গায় এলে পায়ে হেঁটে আশপাশটা একটু না দেখলে কি চলে। রাস্তা থেকে নিচের বৃষ্টিস্নাত চা বাগানের ঢাল ও রেনবো রিসর্টের দৃশ্য দেখে অপূর্ব লাগছিল। দু’পা দূরে চা বাগানের পাশে ‘পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের একটি ওয়াটার ওয়ার্ক্স। এখান থেকে জলের পাইপ লাইন উপরের রংবুল অবধি গেছে। চারিদিক জনহীন। যে দিক থেকে গাড়িতে এসেছিলাম সে দিকেই জঙ্গলে ঢাকা রাস্তায় কিছুটা পদ চারণ করলাম।অনেক নিচ থেকে একটা নদী বা ঝর্ণার বয়ে চলা জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঐ দিকেই বোধহয় রেনবো ফলস। বিকেলের দিকে ‘ব্রেইন ফিভার’ (Brain Fever) ও ‘হুইসলিং থ্রাশ’ (Whistling Thrush) সহ সব পাখির ডাক যেন আরো বেড়েছে। অদ্ভুত সব স্বরে তারা ডেকে চলেছে মাঝে মাঝে, যা কোন জায়গায় গিয়ে হয়ত শুনিনি। ‘ঘষঘষ’, ‘টিকটিক’ থেকে আরম্ভ করে চেনা স্বর ‘পিউ কাঁহা’ – নির্জন এই জগতে তারাই যেন প্রাণের সঞ্চার করছে। একেই বলে বোধহয় ‘শব্দময় নৈশব্দ’।
নববর্ষের সকাল ও রামধনু ঝর্ণা
নববর্ষের সকালে নানা পাখির ডাকে পাহাড়ের প্রকৃতি আবার মুখরিত। এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় না। তাই অন্যান্য পাহাড়ি গ্রামের মত এখানে কাঞ্চনকে দেখার আশা বা উতকন্ঠা নিয়ে সকালে উঠতে হয় না। নির্মল, বিশুদ্ধ পরিবেশে এখানে শুধুই প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া ও অলসভাবে পাহাড় ও চা বাগানের প্রকৃতিকে উপভোগ করা। চা বাগানের পাশে বসে সেই বাগানেরই চা পান করার মজাটাই আলাদা। ‘ব্রেইন ফিভার’ পাখিটা তার রাজ্যে বেড়াতে আসা আমাদের দেখে সকালবেলা যেন ডেকে জিজ্ঞেস করছে ‘এরা কারা?’ আজ এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য ‘রেনবো ফলস’ দেখতে। হোটেল থেকে ৩ কিমি, যার ১ কিমি অবধি গাড়ি যায়, তারপর বাকি পথ হেঁটেই। রোদ থাকলেই সে জলপ্রাপাতে ‘রেনবো’ দেখা যায়। কিন্তু আকাশ কেমন যেন মেঘলা। পুরি-সব্জি সহযোগে ব্রেকফাস্ট করতে করতে রোদ উঠল। তাই আর বিলম্ব না করে অনিমেশরা বেরিয়ে পড়লো ফলসের উদ্দেশে। পাশের ঘরের প্রবীণ দম্পতিও অনিমেশদের সঙ্গী হলেন। তাই গাড়িতেই ১ কিমি পথ যাওয়ার পর তারপর হাঁটা শুরু। রাস্তা থেকে নেমে যাওয়া একটা সিঁড়ির পথে নামতে থাকা। পাহাড়ের গা ঘেঁষে কোথাও ঢালু নেমে যাওয়া পথ, কোথাও বা পাথরের সিঁড়ি আবার কোথাও সিমেন্টের বাঁধানো সিঁড়ি। অনেকাংশেই পথের পাশে রেলিং। তবে জনমানুষের কোন চিহ্ন নেই
সূর্য আবার আছে নিজ রূপে। আস্তে আস্তে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি ও সূর্যের আলোয় ফুটে উঠলো রামধনু সাত রাঙা।
কিভাবে যাবেন ঃ ট্রেনে NGP স্টেশান থেকে গাড়ি করে ক্যালিজ ভ্যালি।
0 মন্তব্যসমূহ