Header Ads Widget

Responsive Advertisement

চলুন ঘুরে আসি রহস্যে মোড়া আড্ডাবাড়ি চা বাগান

আড্ডাবাড়ি চা বাগান যেন অপার রহস্যে মোড়া।




চা এসেছিল অনেক আগে! ১৮৪৭ সালের কোনও এক সময়ে চিনের চা পাতার প্রথম প্রবেশ ভারতের মাটিতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নজরে চা এবং আফিম, দুইই ছিল প্রয়োজনীয় দ্রব্য, আমদানি-রফতানির অন্যতম সামগ্রী। কিন্তু যা সাহেবদের কাছেও ছিল কল্পনার বাইরে তা হল চায়ের জনপ্রিয়তা, আগামী দিনে চা যে কিংবদন্তিতে পরিণত হবে তা এমনকি, রবার্ট ফরচুন, স্কটিশ হর্টিকালচারিস্ট যিনি চা এনেছিলেন ভারতে, তাঁরও জানা ছিল না।

তখন অহম রাজাদের সময়। সাহেবরা তাঁদের কাছ থেকে চা বাগানের জমি-জায়গা কিনে নেয়। আর তারপর থেকেই অসম ধীরে ধীরে চায়ের সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠল।


আকাশ থেকে অসমকে দেখলে মনে হয় যেন একটা সবুজ হীরে আর তারই মধ্যে এঁকেবেঁকে চলেছেবিশাল ব্রহ্মপুত্র, সদা বহমান। জানা আছে কি এই সবুজ হীরের মধ্যে কী আছে? চা এবং চায়ের মাদকতা, এক অনবদ্য জীবন চা-কে ঘিরে। সেই চা বাগানের জীবনকে জানতে হলে টি ট্রেল-এর শরিক হতেই হবে। পাঁচ দিন চার রাতের এই চা ঘেরা জায়গায় বেড়ানোর আগে পৌঁছতে হবে অসমের রাজধানী শহর গুয়াহাটি। পৌঁছে জিরনো প্রয়োজন তাই নভোটেল গুয়াহাটির আমন্ত্রণে সাড়া দিলাম। শহরের একপ্রান্তে সুন্দর বিজনেস লাক্সারি হোটেল।নানা রকমের চা দিয়ে ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক, ওলং, গোলাপ এবং অন্যান্য পেলব চায়ের সওগত, কিন্তু তার মধ্যে টলটলে কাপে অসম চা, অপূর্ব স্বাদ, অসাধারণ ফ্লেভার। নভোটেলের ম্যানেজার কলকাতার বাঙালি রাজর্ষির কথায়: “এই শুরু, এইবারে চায়ে ঘেরা এক ভুবন শুরু।” রাজর্ষির কথায় ছিল এক অদ্ভুত চা-চমকের ইঙ্গ

 অনন্ত সবুজে ভরা বালিপারা ডিভিশন আড্ডাবাড়ি চা বাগানের মধ্যে ১৮৬৪-তে তৈরি অনিন্দ্য সুন্দর এক প্ল্যানটার’স বাংলো, যা বর্তমানে হেরিটেজ রিসর্ট। স্বনামধন্য রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক জটায়ুর মতোই আমারও মনে হচ্ছিল,‘থ্রিলিং ব্যাপার মশাই।

ঝকঝকে নীল আকাশ, চা বাগানের মেয়েরা তাঁদের নরম আঙুল দিয়ে দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি বেছে চলেছেন। এই জন্য এক শহুরে সভ্যতার বাইরের জগৎ ইন্টারনেট এবং টিভিবিহীন, অনেকটা যে রকম ছুটি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র চার যুবক কাটিয়েছিলেন। চায়ের প্রকারের অনুকরণে চারটি বাংলোর নামকরণ। মূল বাংলো বড়সাহেবের বাংলো, যাতে এক সময় ব্রিটিশ প্ল্যান্টারের বাস ছিল, ভিক্টোরিয়ান আর্কিটেকচারের এক দারুণ উদাহরণ। ছাদ, ঢালু ছাদ, পিলার, বড় সাহেবি জানালা, মনে হয় যেন হ্যাট এবং খাকি হাফ প্যান্ট পরা কোনও সাহেব বেরিয়ে আসবে এক্ষুনি। বাকি তিনটি বাংলোর নাম গোল্ডেন টিপস, ফার্স্ট ফ্লাশ আর সিলভার টিপস। চতুর্থটি হল অ্যামবরসিয়া।


১৮৬৪-তে তৈরি এই প্ল্যানটার'স বাংলো বর্তমানে হেরিটেজ রিসর্ট।

ফার্স্ট ফ্লাশ হল একান্ত ডাইনিং বা খানাপিনার বাংলো, যাতে বারের আলাদা ব্যবস্থা আছে। শৌখিন পর্যটকদের কথা মনে রেখেই ব্যবস্থা। সব ক’টি হেরিটেজ রিসর্ট, আর বলাই বাহুল্য যে এই বাংলোগুলিতে থাকার অভিজ্ঞতা আপনাকে যেন নিয়ে যাবে উনবিংশ শতাব্দীতে, যখন জীবনযাত্রা ছিল নিতান্তই স্থির। আজ যা নতুন করে প্রচার করা হচ্ছে, স্লো ট্র্যাভেল আর ডিটক্সটা উনবিংশ শতাব্দীর দৈনন্দিন ছন্দ ছিল। আর ওয়াইল্ড মহাসিরে চার দিন থাকার মানেই হল এই প্রশান্তির আবাহন
 গোল্ডেন টিপস মানে চায়ের কুণ্ডি, প্রতি মরসুমে সবচেয়ে আগে যা চা তৈরি হয় এই কুণ্ডি থেকে। যে কুণ্ডি তোলার জন্য মেয়েরা তাদের আঙুল রাখে কলির মতো। ব্রিটিশ জমানার এই বিশালবাংলোর আমেজ আলাদা। বিকেলে চা গাছের কাঠের তৈরি ট্রে-তে চা এল। দীর্ঘক্ষণ ধরে একটু একটু করে চা পান, সঙ্গে শুধু শ্যাম্পেনের তুলনাই চলে। বিকেলবেলায় সূর্যের পড়ন্ত আলোয় হাঁটতে বেরোলাম চা বাগানের মধ্য দিয়ে, নিঃশব্দের হাত ধরে।

চা বাগানের মধ্যে ছুটি কাটানোর মানে বাগানের সঙ্গে পরিচিতি আর অবশ্যই তাতে চা তৈরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জানা। কৌতূহল অনেক, কেমন করে চা গাছের পাতা থেকে অপূর্ব চা কাপে এসে পৌঁছয়। এই গল্পে এক মহা চুরির গল্প লুকিয়ে আছে, তা চায়ের সঙ্গে এক অনাবিল আড্ডায় চা বাগানের ম্যানেজার অনুপ সেই গল্প শোনান উৎসুক পর্যটকদের।


ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে দু'দণ্ডের অবকাশ।

গল্পটা অনেকটা এই রকম। ১৮৪৩ সালে স্কটিশ হর্টিকালচারিস্ট রবার্ট ফরচুন চোরাগোপ্তা পথে উত্তর চিনের সাংহাই এবং হান্‌জো জেলায় বহুমাস ঘুরে বেড়ান চৈনিক সেজে। পর্যবেক্ষণ করেন ২০০০ বছরের পুরনো চায়ের শিল্প। অবশেষে ১৩০০ চারা আর ১০০০ বীজ নিয়ে স্কট গুপ্তচরের কায়দায় ভারতে ফিরে আসেন। আর অসমে এবং দার্জিলিংয়ে শুরু হয় চা পাতার চাষ।মহাচুরি যাকে বলে, কিন্তু সেই চুরি না হলে দেশের মাটিতে চায়ের ফলন হত না। ১৮৪৭-এ এরপর শুরু হল রমরমিয়ে ব্যবসা আর চা হয়ে গেল ভারতীয় তথা বাঙালি জীবনের ভরসা।


শুধু দু'টি পাতা একটি কুঁড়িই নয়, মন কাড়ে রঙিন ফুলের দল।

 জাপানি ফরেস্ট বাথিং বা ‘শিরিন ইোকো’, বা সহজে বলা যায় প্রকৃতি স্নান। আশির দশকে জাপানে উদ্ভূত এই হিলিং হেলথকেয়ার। জঙ্গলে বা প্রাকৃতিক সবুজে সময় কাটানোর যে স্বাস্থ্যকর উপায় আছে তা জাপান এবং বিশ্বে পরীক্ষিত। বলা হয়,জঙ্গলে স্নানে রক্তচাপ আর স্ট্রেস দুইই কমে। সবচেয়ে স্নিগ্ধ অনুভব ছিল তা হল এক অপূর্ব শান্তি। চারটি দিন কেটে গেল পলক ফেলতে না ফেলতেই। এই প্রথম এক চা-কেন্দ্রিক মদির জগতে বেড়ানো।

তবে এখনও একটু বাকি! ১৮০ কিলোমিটার পার হয়ে আবার নভোটেল, গুয়াহাটিতে ফেরা।অতুলনীয় চমক ছিল লুকিয়ে রাখা এইখানে। শেষ সন্ধ্যার খাবার টেবিলে হল চমক প্রকাশ— একটা ৫ কোর্সের মিলই চা দিয়ে তৈরি! এগজিকিউটিভ শেফ সুজিত চক্রবর্তীর নিজের হাতে করা এক বিশেষ প্ল্যাটার যাতে চা হল সবচেয়ে জরুরি উপকরণ। চা দিয়ে তৈরি সব্জি, মাছ, মাংস, এমনকি মিষ্টিও!

আরও এক বার জটায়ুকে মনে করতেই হল,‘থ্রিলিং ব্যাপার মশাই!’

কী ভাবে যাবেনঃ
কলকাতা থেকে ট্রেনে বা প্লেনে গুয়া।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ