অগ্রদ্বীপের মেলা ও ইতিহাস ::
::বাংলার অন্যতম বৃহৎ মেলা##
অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ ঠাকুর"
১৯৬৮
সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পায়ে হেঁটে ১৪ কিমি পথ গেছি এই অগ্রদ্বীপের
গোপীনাথের মেলায় . .... তখন পাকা রাস্তা ছিল না .....এপাড়া-ওপাড়ার ভিতর
দিয়ে ভোর চারটের সময় রওনা দিয়ে বেলা নটার সময় পৌঁছতাম অগ্রদ্বীপের
মেলায়........ একরাত গাছের নিচে থেকে পরের দিন বিকেলে রওনা দিতাম বাড়ির
দিকে......
“মেলার ইতিহাস” লিখেছে স্কুলের বন্ধু “দীনবন্ধু ঘোষ”
"গোবিন্দ
বাপ্ আমার ! তুমি কি আমাকে এইভাবে উপোস করিয়ে রাখবে বাপ্ ! সারাদিন
একবিন্দু জল ও দিলে না আমায় !" -- কথাগুলো গোবিন্দ ঘোষের কানে যেতেই বুকের
ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো । ভাবছেন "একি করেছি আমি " -- কিন্তু মনের বেদনা
চেপে রেখে ক্ষোভের সঙ্গে বললেন,"ঠাকুর, আমার পুত্রটি তুমি কেড়ে নিলে,
তোমার একটু ও দয়া হোলো না ? এইযে তোমার বাপ্ বাপ্ করে ডাকা, এসব তো তোমার
বাইরের ।" উত্তরে গোপীনাথ ঠাকুর বলছেন, "এরূপ বিপদ চিরকালই লোকের হয়ে থাকে
, তোমার একার হয়নি । তোমার ছেলের ভালোই হবে, তুমি দুঃখ সংবরণ করো ।"
কথোপকথন গোপীনাথ ঠাকুর আর গোবিন্দ ঘোষের মধ্যে হচ্ছিল । গোবিন্দ ঘোষের এই
যে ঠাকুরকে সারাদিন উপোস করিয়ে রাখার কারন খুঁজতে হলে আমাদের একটু পিছিয়ে
যেতে হবে ।
----------------------------
------------------------------
মহাপ্রভু
শ্রীগৌরাঙ্গ সহস্রাধিক পার্ষদ সঙ্গে বৃন্দাবন দর্শনে চলেছেন । অন্যান্য
ভক্তদের সঙ্গে গোবিন্দ ঘোষ ও আছেন ।পথে একদিন শ্রীগৌরাঙ্গ ভোজনান্তে
মুখশুদ্ধি চাইলেন । গোবিন্দ ঘোষ গ্রামের ভিতর থেকে হরীতকী এনে প্রভুকে
একখন্ড দিলেন । পরের দিন প্রভু অগ্রদ্বীপে ভিক্ষা করলেন । আহারান্তে প্রভু
হাত পাতলেন । গোবিন্দ ঘোষ তাঁর বহির্বাসে যে হরীতকী খন্ডটি বাঁধা ছিল তা
খুলে প্রভুর হাতে দিলেন । প্রভু যেন নিদ্রোত্থিতের মতো জেগে গোবিন্দকে
বললেন, "কাল তুমি মুখশুদ্ধি কিছু দেরিতে দিয়েছিলে কিন্তু আজ চাইবামাত্র কি
করে দিলে ?" গোবিন্দ ঘোষ বললেন যে কালকের একখন্ড হরীতকী তিনি বেঁধে
রেখেছিলেন , তাই দিলেন । প্রভু হেসে বললেন, "গোবিন্দ, তোমার সঞ্চয় বাসনা
এখনও সম্পূর্ণ যায়নি , তাই তুমি আমার সঙ্গে আর এসো না ।" একথা শুনে তো
গোবিন্দের মুখ শুকিয়ে গেল, তিনি হাহাকার করে উঠলেন । প্রভু
বললেন,"গোবিন্দ, শান্ত হও, তুমি দুঃখ কোরো না । তোমাকে দিয়ে আমি অনেক কাজ
সম্পন্ন কোরবো । আসলে তোমার হৃদয়ে কোনরূপ সঞ্চয় বাসনা না থাকা সত্ত্বেও
আমার ইচ্ছাতেই এরূপ হয়েছিল । আমি অচিরেই তোমার কর্তব্যকর্ম নির্দেশ কোরবো।
আমি আবার তোমার কাছে আসবো আর সেবার তোমাকে ছেড়ে যাবো না। তুমি এখানেই
থাকো ।" গোবিন্দ ঘোষ অগ্রদ্বীপেই রয়ে গেলেন। গঙ্গাতীরে একটি কুটীর তৈরি
করে, প্রভু আবার আসবেন এই আশায় দিনরাত ভজন করতে লাগলেন ।
একদিন
গোবিন্দ গঙ্গাতীরে প্রভুর শ্রীচরণ ধ্যান করছেন এমন সময় কি যেন একটা
গঙ্গার স্রোতে ভেসে এসে তাঁর গায়ে ঠেকলো । ধ্যান ভেঙ্গে গেলে দেখলেন যেন
একটা পোড়াকাঠ । শ্মশানের কাঠ ভেবে তা উঠিয়ে তীরে রেখে আবার ধ্যানে বসলেন ।
একটু পরে বোধ হোলো যেন শ্রীগৌরাঙ্গ তাঁর হৃদয়ে উদয় হয়ে বলছেন, "গোবিন্দ
আমি আসছি । তুমি যা পোড়াকাঠ ভাবছো ওটিকে যত্ন করে কুটীরে রেখে দাও ।"
ধ্যান ভাঙলে গোবিন্দ কাঠখানা কুড়িয়ে এনে কুটীরে রেখে দিলেন । পরদিন সকালে
দেখলেন যে সেটি পোড়াকাঠ নয়, তা একখানি কালো পাথর । এতে গোবিন্দ অত্যন্ত
আশ্চর্য্য হলেন এবং শ্রীগৌরাঙ্গের আগমনের অপেক্ষায় রইলেন ।
একদিন
প্রভু সদলবলে গোবিন্দের কুটীরে এসে উপস্থিত হলেন আর জিজ্ঞেস
করলেন,"গোবিন্দ, পাথরখানি পেয়েছো তো ?" গোবিন্দ করজোড়ে হাঁ বলাতে প্রভু
বললেন,"উহা দিয়ে শ্রীবিগ্রহ স্থাপন কোরবো " । পরদিন একজন ভাস্কর এসে
উপস্থিত হলে প্রভু তাকে শ্রীমূর্তি প্রস্তুত করতে দিলেন । সে খুব কম সময়ের
মধ্যে শ্রীমূর্তি তৈরি করে দিল । তখন প্রভু নিজহাতে গোবিন্দের কুটীরে সেই
শ্রীমূর্তি স্থাপন করলেন এবং শ্রীবিগ্রহের নাম রাখলেন"গোপীনাথ" আর এইভাবেই
"অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ" প্রকাশ পেলেন । ঠাকুর স্থাপিত হলে শ্রীগৌরাঙ্গ
বললেন, "গোবিন্দ, এই ঠাকুরের মাঝেই আমি তোমার কাছে রইলাম ।আর কখনও তোমাকে
ত্যাগ কোরবো না । তুমি এঁর সেবা করো, আর কখনও আমার বিরহজনিত দুঃখ পাবে না" ।
এই কথা শুনে গোবিন্দ রোদন করতে লাগলেন, কারণ তাঁর মন শ্রীগৌরাঙ্গে,
গোপীনাথে নয় । তখন প্রভু আশ্বাস দিয়ে তাঁকে বললেন, "গোবিন্দ, তুমি এই
ঠাকুর সেবা করো আর বিয়ে করো । শ্রীভগবান তোমাকে দিয়ে দেখাবেন যে তিনি কতো
ভক্তবৎসল । সেই সৌভাগ্যকে তুমি তুচ্ছ ভেবো না" । এই বলে শ্রীগৌরাঙ্গ দলবল
নিয়ে চলে গেলেন আর গোবিন্দ অগ্রদ্বীপেই রয়ে গেলেন । প্রভুর আজ্ঞানুসারে
বিয়ে করলেন । স্ত্রী-পুরুষে গোপীনাথের সেবা করেন আর গোপীনাথের প্রসাদ
পেয়ে জীবন ধারণ করেন । কিছুদিন পর গোবিন্দের একটি ছেলে হোলে, ছেলেটি রেখে
গোবিন্দের স্ত্রী পরলোকগমন করলেন । গোবিন্দের ঘাড়ে এখন দুটি সেবার বস্তু
পড়ল-গোপীনাথ আর নিজের শিশুপুত্র । কষ্টেসৃষ্টে দুজনকেই সেবা করতে লাগলেন ।
ক্রমে ছেলের বয়স পাঁচ বছর হোলো । গোবিন্দ গোপীনাথকেও পাঁচ বছরের শিশু
ভেবে বাৎসল্যভাবেই সেবা করেন ।
গোবিন্দের মন এখন
দুজনেই আকর্ষণ করতে লাগলো । এতে মাঝে মাঝে গোলমাল হতে লাগলো । কখনো পুত্রকে
দেখে ভাবেন গোপীনাথ আবার কখনো গোপীনাথকে দেখে ভাবেন তাঁর পুত্র । কখনো
গোপীনাথকে দুঃখ দিয়ে পুত্রের সেবা করেন আবার কখনো পুত্রকে দুঃখ দিয়ে
গোপীনাথের সেবা করেন । এমন সময় রসিকশেখর শ্রীভগবান গোবিন্দের পুত্রটিকে
নিয়ে নিলেন । তখন গোবিন্দ শোকে দুঃখে কাতর হয়ে সঙ্কল্প করলেন, গোপীনাথের
ঘরে হত্যা দিয়ে উপোস করে প্রাণ ত্যাগ করবেন । আসলে গোপীনাথের উপরে তাঁর
রাগ হয়েছে আর ভাবছেন, "আমি দিনরাত ঠাকুরের সেবা করি, আর ঠাকুর এমনি
অকৃতজ্ঞ যে আমার পুত্রটি নিয়ে নিলেন ! " গোবিন্দ মনের দুঃখে ঠাকুরের আগে
পড়ে রইলেন । কাজেই গোপীনাথের কোনো সেবা হোলো না , সারাদিন উপবাসে থাকতে
হোলো । গোবিন্দ ভাবছেন, "যেমন আমার বুকে শেল হানলে, তেমনি দেখি কে ওঁকে
খেতে দেয় ! ওঁকে অপরাধ দিয়ে আমি এখানেই প্রাণত্যাগ কোরবো"। গোবিন্দের এই
ব্যবহারে কিন্তু গোপীনাথ রাগ করলেন না । কারণ গোবিন্দ জীব আর গোপীনাথ ভগবান
। সন্তান যেমন মাকে দুঃখ দেয় সেইরকম জীবমাত্রেই শ্রীভগবানকে দুঃখ দিয়ে
থাকে । ইহাতে মা কখনো ক্রুদ্ধ হলেও শ্রীভগবানের ক্রোধ হয় না । এই ভাবে যখন
দিন শেষ হয়ে রাত হোলো তখন গোপীনাথ বললেন, "গোবিন্দ বাপ্ ! খিদেয় যে আমি
মরি , তোমার কি দয়ামায়া নেই বাপ্ !" গোপীনাথ আর গোবিন্দের সঙ্গে মাঝে
মাঝেই এরূপ কথাবার্তা হোতো ।
----------------------
এসব
শুনে গোবিন্দ পড়লেন কিছু ফাঁপরে । কিছু ভেবে না পেয়ে শেষে বললেন,
"ঠাকুর, বুঝলাম আমার পুত্রের উত্তম গতি হয়েছে, কিন্তু তুমি আমাকে পুত্রশোক
দিলে কেন ? মাতৃহীন শিশুটিকে আমার কোল থেকে কেড়ে নিলে, তোমার একটু দয়া
হোলো না ?" তখন গোপীনাথ বলছেন, "গোবিন্দ, যার দুই পুত্র, সেই পিতার পুত্র
আমি হতে পারিনা । তুমি ছিলে পিতা, আমি ছিলাম এক পুত্র । কিন্তু যখন তোমার
আর একটি পুত্র হোলো তখন আমি আর থাকতে পারি না । আমি গেলে তুমি হয়তো তোমার
দুই পুত্রকেই হারাতে । আমাকেও পেতে না আর হয়তো তোমার পুত্রকেও পেতে না ।
তোমার সে পুত্র যাওয়াতে এখন তুমি আমাকে ও পাবে, তাকে ও পাবে । তাই গোবিন্দ
দুঃখ ভোলো, তোমার এক পুত্র গিয়েছে তেমনি আমি তোমার পুত্র রইলাম" । একথা
শুনে গোবিন্দ একেবারে নিরুত্তর, হঠাৎ বললেন, "জানি তুমি আমার
সর্বাঙ্গসুন্দর পুত্র । কিন্তু আমি মরলে তুমি কি আমার শ্রাদ্ধ করবে" ? অমনি
গোপীনাথ মধুর স্বরে বললেন, "বেশ গোবিন্দ, তুমি আমার পিতা, আমি শাস্ত্রমতে
তোমার শ্রাদ্ধ কোরবো, প্রতিশ্রুতি দিলাম" । তখন গোবিন্দ কাঁদতে কাঁদতে
বললেন, "বাপ্ , আমি অপরাধ করেছি ! আমাকে ক্ষমা করো । আমার পুত্র মারা গিয়ে
ভালোই হয়েছে, তোমার বালাই গিয়েছে " । এই বলে স্নান করে গোপীনাথের জন্য
রান্না করতে গেলেন ।
এর কিছুদিন পর গোবিন্দ ঘোষ ঠাকুর
অন্তর্ধান করলেন । দেহত্যাগের পূর্বে গোপীনাথের সেবার উত্তম বন্দোবস্ত করে
তাঁর প্রধান শিষ্যের হাতে গোপীনাথকে সমর্পণ করলেন । অগ্রদ্বীপেই ঘোষ
ঠাকুরের সমাধি দেওয়া হোলো । কথিত আছে যে গোবিন্দ ঘোষের অন্তর্ধানের সময়
স্বয়ং গোপীনাথ রোদন করেছিলেন, তাঁর পদ্মচক্ষু থেকে বিন্দু বিন্দু জল পড়তে
থাকে । গোপীনাথ নিশিযোগে নূতন সেবাইতকে বললেন, "গোবিন্দ ঘোষ আমার পিতা ।
আমি একমাস অশৌচ ও হবিষ্যান্ন গ্রহণ কোরবো । তুমি কাল আমাকে স্নান করিয়ে
সেই মতো বসন পরাবে " । সেবাইত সেই অলৌকিক ব্যাপারে একটু স্তম্ভিত হয়ে পরে
একটু সাহসী হয়ে বোললে, "প্রভু লোকে আমাকে কি বলবে ?" ইহাতে গোপীনাথ
বললেন,"আমি পিতার কাছে প্রতিশ্রুত আছি যে আমি তার শ্রাদ্ধ করবো এবং নিজহাতে
পিন্ডদান করবো । তুমি আমার কথামতো কাজ করো । তোমার কোনো ভয় নেই ।" সকালে
সেবাইত এই কথা সকলের নিকট বললে, সকলে ভগবানের করুণায় গদগদ হয়ে বললেন,
"তাঁর সাক্ষাৎ আজ্ঞার উপর কোনো কথা নেই, তিনি যা বলেছেন তাই করা হোক" ।
এরপর মধুমাসে কৃষ্ণ একাদশী তিথিতে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ হোলো । কাচাগলায়
গোপীনাথকে শ্রাদ্ধস্থানে আনা হোলো । ভগবানের কারুণ্যে সকলে উন্মাদবৎ হয়ে
গেলেন । কেহ গোপীনাথকে কেহ বা ঘোষঠাকুরকে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন । সকলেই
বলতে লাগলেন যেমন ভক্ত তেমন ঠাকুর, যেমন দাস তেমন প্রভু, যেমন পিতা তেমনি
পুত্র । কথিত আছে যে গোপীনাথ নিজহাতে সর্বসমক্ষে গোবিন্দ ঘোষের পিন্ড
দিয়েছিলেন । শ্রীভগবানের এই অপরূপ লীলা আজ অবধি অগ্রদ্বীপে প্রতিবছর হয়ে
চলেছে । একান্ত ভক্তগন এখনো এই পিন্ডদান রূপ কাজ দেখে থাকেন । যদি
গোবিন্দের ঔরসজাত পুত্র বেঁচে থাকতেন তবে বড়জোর বিশ বছর তাঁর পিতার
শ্রাদ্ধ করতেন ! কিন্তু গোপীনাথ ঠাকুর পাঁচ শতাধিক বছর ধরে ঘোষ ঠাকুরের
শ্রাদ্ধ করছেন । এইরূপ পিতৃভক্ত পুত্র একমাত্র গোপীনাথই হতে পারেন ।
শ্রীগৌরাঙ্গ
বলেছিলেন, "হে গোবিন্দ, তোমাকে দিয়ে শ্রীভগবানের ভক্তবাৎসল্যের পরাকাষ্ঠা
দেখান হবে । এরূপ সৌভাগ্য তুমি পরিত্যাগ কোরো না "। আর এই ভাবেই গোপীনাথ
ঠাকুর তা দেখালেন গোবিন্দ ঘোষকে দিয়ে ।
তথ্যসূত্র ঃ----
১) মহাত্মা শিশির কুমার ঘোষ রচিত -- "শ্রী অমিয় নিমাই চরিত" ।
![]() |
0 মন্তব্যসমূহ