চোপতা, তুঙ্গনাথ
পাহাড়
কেন ভালো লাগে ? কেন পাহাড়ের টানে বারবার ছুটে যাই ? জর্জ ম্যালরীর সেই
বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যায় “Because it is there” l অনেক বছর আগে কোন এক
ভ্রমণ ম্যাগাজিনে প্রথম চোপতার ছবি দেখি এবং দেখা মাত্র তার প্রেমে পড়ে যাই
। চোপতার নির্জনতা সর্বোপরি মাথার উপর চৌখাম্বার উজ্জ্বল উপস্থিতি মনপ্রান
ভরিয়ে তোলে । আবার চোপতা হল তুঙ্গনাথের দুয়ার । এখান থেকেই তুঙ্গনাথের
হাঁটা পথের শুরু I আমার প্রথম কেদারবদ্রী যাত্রা ২০০৩ সালে । সেবার আমার
তুঙ্গনাথ দর্শনও হয়েছিল । কেদার দর্শন করে আমরা গৌরীকুন্ড থেকে সরাসরি গাড়ী
করে ঊখীমঠে এসে একরাত থেকে পরদিন বিকেল বেলা ২৭ কিমি দূরে চোপতায় এসেছিলাম
। তখন চোপতায় দুতিনটি পাকা হোটেল ছিল । আর বেশীরভাগ ছিল টালির ছাদ দেওয়া
কাঁচা ঘর, সাথে কয়েকটি সাবেক কালের চটিও ছিল । হোটেলের ঘর পেয়ে যাওয়াতে
আমরা হোটেলেই উঠেছিলাম । পরদিন সকালে তুঙ্গনাথ ট্রেক করবো এ রকমই বাসনা ছিল
। আগের দিন সন্ধেবেলা তুঙ্গনাথ যাবার তোরণ ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে
একটি চটিতে গিয়ে বসলাম । চটির নাম মঙ্গল চটি । চটির মালিকের নাম আমি আগেই
শুনেছি এবং উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বইতে তার শেষ জীবনের হিমালয় ভ্রমনের
সঙ্গী মঙ্গল সিং এর নাম আমি পড়েছি । তখন মঙ্গলজির অনেক বয়স । চটিতে ঢুকতেই
মঙ্গলজি আমাদের বসতে বললেন । কলকাতা থেকে এসেছি শুনে সাগ্রহে সব খবর জানতে
চাইলেন । কথায় কথায় প্রসাদজির (উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ) কথা উঠল, মঙ্গলজির
চোখ ছলছল করে উঠল । তুঙ্গনাথ যাবার খুটিনাটি ওনার কাছ থেকে জেনে নিলাম ।
আমাদের ঘোড়া নিতে না করলেন, পায়ে হেটে উঠতে বললেন । পরদিন সকালে মঙ্গল চটি
থেকেই প্রাতরাশ সেরে তুঙ্গনাথের উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিয়েছিলাম । তারপর আবার
কেদারবদ্রী গিয়েছিলাম ২০০৫ সালে । সেবার মঙ্গল চটিতে গিয়ে দেখলাম মঙ্গল সিং
এর ভাই লক্ষণ সিং চটিতে রয়েছে । সে বলল দাদা মকুমঠে রয়েছে এবং খুব অসুস্থ ।
তার কিছুদিন পরেই শুনলাম মঙ্গল সিং আর নেই । মনটা ব্যাথায় ভরে উঠেছিল ।
আজও চোখ বুজলেই স্পষ্ট দেখতে পাই সরলতা ভরা মুখের সেই নিস্পাপ মিষ্টি হাসি ।
তুঙ্গনাথে আমি হেটেই উঠেছিলাম I মাত্র সাড়ে তিন কিমি রাস্তা কিন্তু শেষ
দিকে দুরন্ত চড়াই ৷ আর হবে নাই বা কেন, চোপতার উচ্চতা ৯০০০ ফুট আর তুঙ্গনাথ
১২০০০ ফুট ৷ পঞ্চ কেদারের মধ্যে তুঙ্গনাথই সবচেয়ে উচু ৷ কিন্তু চলার পথের
দৃশ্য আপনার মনকে ভরিয়ে দেবে ৷ পথে আপনার সঙ্গী হবে চৌখাম্বা, আপনার পথ
চলার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে, আর পথে পাবেন অনেক বুগিয়াল ৷ তুঙ্গনাথেও অল্প
কিছু থাকার জায়গা আছে, সেখানে একরাত থেকে পরদিন খুব ভোরে আরও উপরে
চন্দ্রশীলা ঘুরে আসতে পারেন ৷ ভোরের প্রথম আলোয় সেখানকার দৃশ্য আপনার সারা
জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে ৷ আমার হাতে সময় না থাকার জন্য আমি চন্দ্রশীলা যেতে
পারি নি ৷ আমি এখন চলেছি বদ্রীনাথের পথে, চোপতার পর আমার পরবর্ত্তী
গন্তব্য হল ১৩৫ কিমি দূরের যোশীমঠ ৷ চামোলী হয়ে সে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টার
রাস্তা ৷ চোপতা থেকে দুপুরের খাওয়া খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম, যোশীমঠে পৌছাতে
প্রায় সন্ধ্যে ৷ গিয়েই শুনলাম বদ্রীর রাস্তায় ধ্বস নেমেছে তাই রাস্তা বন্ধ ৷
ধ্বস এ পথের নিত্য সঙ্গী ৷ যোশীমঠে না জানি কতদিন বসে থাকতে হবে ৷
0 মন্তব্যসমূহ