নদীয়ার দিগনগর আর তোপখানা মসজিদ
গোপাল ভাঁড়ের গল্প ও কার্টুনের দৌলতে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম তো আজ ঘরে ঘরে । কিন্ত রাজা রাঘব রায়কে চেনে ক'জন ? মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজা রাঘব রায় । কৃষ্ণচন্দ্র রাজবাড়িও তার হাতেই প্রতিষ্ঠিত । রাজবাড়ির ভিডিও দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন । রাজা রঘব রায় ধার্মিক নরপতি ছিলেন। তিনি অনেক দিঘী খনন করেছিলেন। কহবত আছে তিনি সদলবলে শান্তিপুর যাচ্ছিলেন। পানীয় জলের অভাবে জল ধার করার ব্যাবস্থা ছিল। রাজা শুনতে পারলেন পাশেই এক গ্রামে ধার করা জল শোধ না দিতে পারায় জোরদার ঝগড়া বেঁধেছে। মহারাজ কালবিলম্ব না করে সেইদিনই খনন কাজ শুরু করতে হুকুম দেন। আশ্চর্য বিষয় ঘোড়ার পিঠে উঠে ঘোড়ার পিঠে চাবুক কশালে ঘোড়া দৌড়ে যেখানে থামবে বা শেষ করবে, সেই অবধি জলাশয়টি হবে। কাজ শুরু হয়ে গেল। প্রায় ২০০০০ মুদ্রা ব্যায় করে এই দিঘীর খনন কাজ সম্পূর্ণ হয়। সালটা ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। দিঘীতে স্নান ঘাট, একটি সুন্দর অট্টালিকা ও পাশে দু'টি শিব মন্দির স্থাপন করেন। মন্দিরের নামকরণ হয় রাঘবেশ্বর শিব মন্দির। এখনও একটা মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। আর এই দিঘীর নামে গ্রামের নাম দিগনগর, অর্থাৎ দীর্ঘিকানগর বা দীঘনগর অপভ্রংশ দিগনগর।
এই দিগনগরের সাথ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বড় ভগ্নি সৌদামিনির সঙ্গে দিগনগরের যাদবেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবাহ হয়। ঠাকুরবাড়ীর সাথে কুলিন ব্রাহ্মণের বিবাহ হওয়ায় তৎকালীন ব্রাহ্মণগণ গাঙ্গুলী মশাইকে সমাজচ্যুৎ করেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিগনগরে আসেন।
যতদূর জানা যায় তিনি লঞ্চ করে কলকাতা থেকে শান্তিপুর আসেন । শান্তিপুর থেকে ঘোড়ার গাড়িতে দিগনগর আসেন। সারা দুপুর কাটিয়ে দুই সংসারের মিলিত ভোজানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বিকেলে ফিরে যান। সেই সময় একটি ছড়া লিখলেন, দিগনগরের দিঘীতে মেয়েদের স্নান করা দেখে --
'দিগনগরের মেয়েগুল নাইতে নেমেছে
চিকন চিকন চুলগুলি সব ঝাড়তে লেগেছে।।'
দিগনগরে দিঘী দেখতে আসুন। একদিনের ভ্রমণই যথেষ্ট। দিঘীর যাওয়ার পথে পড়বে রাঘবেশ্বর শিব মন্দিরটি। এটি মহারজ রাঘব রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আদতে শিব মন্দির। মন্দিরের গায়ে খুব সুন্দর এবং আকর্ষণীয় টেরাকোটার কাজ। মন্দিরকে ঘিরে প্রতিবছর চড়ক উৎসব হয়। উৎসবের অঙ্গ গাজন, অষ্টক, বালাকি, শিবরাত্রির অনুষ্ঠান, কথকতা, রামায়ণ গান, কীর্তনাদি হয়ে থাকে।
জলেশ্বর শিব মন্দির :- দিগনগর থেকে ৭ কিমি দূরে শান্তিপুরে জলেশ্বর মন্দির। সপ্তদশের শেষ দিকে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরের সেবায়ত ছিলেন বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব কালীচরন চট্টোপাধ্যায় মাতামহ তাঁর পূর্ব পুরুষগণ। কালীচরণবাবু এই মন্দিরের সংস্কার করেন।
এই মন্দির চড়কপূজা, গাজন ও কীর্তনাদি নিয়মিত হয়। মন্দিরটি বেজপুরে অবস্থিত। মন্দিরটি উঁচু এবং চারচালা পদ্ধতিতে নির্মিত।
তোপাখানা মসজিদ:-
যেমন শাক্ত ও বৈষ্ণব-এর মিলন স্থল হল এই শান্তিপুর। তোপখানা মসজিদ দেখার মত। তন্তুবায় আর সুতার কাজে যুক্ত মানুষের বসবাসি হচ্ছে সুতারগড়। অন্যমতে সৈন্যদের গড়কেই বলে সুতারগড়।
ঔরাঙ্গজেবের রাজত্ব কালে সৈন্য নিবাস তৈরী হয় ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে। সৈয়দ মেহবুব আলম দিল্লীশ্বর তাকে শান্তিপুরে পাঠান।তিনি শান্তিপুরে বহু আয়ামা সম্পত্তি পেয়ে জান। সেই সম্পতির উপর সৈন্যদের থাকবার জায়গা, অতিথি আবাসছ, মাদ্রাসা স্থাপন করেন। গাজী ইয়ার মহব্বত সৈন্য দলের সেনাপতি ছিলেন। মহব্বত আলম সাহেবর কথা মত এবং মায়ের একান্ত অনুরোধ মত এই মসজিদ নির্মাণ করান। একটি বৃহত গম্বুজে ৪ টি বড় ও ৪ টি ছোট মিনার আছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে সাহেবের এবং তার পূত্রের সমাধী আছে। পাশে আছে পীরের হাট। তোপখানা মসজিদের বয়স ৩০০ বছর। এই ঐতিহ্যমন্ডিত মসজিদ নিয়ে অনেকেই গবেষণার কাজে যুক্ত আছেন।
কিভাবে পৌঁছাবেন :-
শিয়ালদহ থেকে শান্তিপুর লোকালে শান্তিপুর। টোটোয় ঘুরে দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে চলে আসুন দিগনগরে রাঘবেশ্বর মন্দির ও বিশাল দিঘীর চারপাশ ঘুরে ফিরতি ট্রেনে বাড়ি ফেরা।
থাকতে হলে শান্তিপুরে হোটেল ও লজ পাওয়া যাবে।
0 মন্তব্যসমূহ