লুম্বিনী বুদ্ধদেবের পুণ্যভূমিতে.ঃ- ডিসেম্বরের হালকা রোদ্দুরে টান টান দ্বিপ্রহরে শুভ্রদের গাড়ি চিতায়ন থেকে সোজা ছুটলো লুম্বিনীর পথে। পথ দীর্ঘ কিন্তু বৈচিত্র্যময়। নেপালের তরাই অঞ্চল ছুঁয়ে চলছে শুভ্রদের গাড়ি। চওড়া নদী পার হয়ে চলা। কোথাও উন্মুক্ত প্রান্তর, কোথাও হালকা পাহাড়ের ঢাল, কোথাও শালের জঙ্গল। শালের জঙ্গলের ঘনত্ব কোথাও বাড়ছে, কোথাও কমছে। শাল বনের ফাঁকা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পার্শ্ববর্তি ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামগুলির চেহারা অলস।
পথে নানান জায়গায় থামতে থামতে একেবারে ভৈরবায় এসে পড়লো শুভরা।
জেনে নেওয়া ভালো উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর হয়ে সোনাউলি হয়েও লুম্বিনী যাওয়া যায়। এই রুটটা সহজ এবং সরল।
ভৈরবাতে পেয়ে গেলো শুভরা বিশাল রাজপথ। রাজপথ জুড়ে তোরণ। এই তোরণের উপর লেখা আছে লুম্বিনী আসার জন্য স্বাগত। পাশেই বাজার। বাজারে ঘুরাফেরা করতে করতে চীন, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশ থেকে এসেছেন বৌদ্ধদের দেখা মিলবে। তবে কোলাহলহীন নিস্তব্ধায় লুম্বিনী উদ্যান খুবই চমকপ্রদ। উদ্যানের পাঁচ নম্বর গেটে অনেকগুলি দোকান, সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত এবং পূজার্চনার সামিগ্রী বিক্রি হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে সুন্দর বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধ প্রর্থনা পতকা, তিব্বতী ধূপ আগর বাতি। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সন্নাসীনী ও লামারা এইসব সামগ্রী কিনছেন। সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় যপের মালা, যা সব সময় বৌদ্ধরা কাছে রাখেন। শুভরা সব ঘুরে দেখছে।
লুম্বিনী উদ্যান বিশাল আয়তকার। তারই মধ্যিখানে শ্বেতশুভ্র বৌদ্ধস্তুপ। চারিদিকে শুনশান। স্তুপের চারধারে বুদ্ধের জীবনের চার অধ্যায় আবির্ভাব, বোধগয়ায় বোধিলাভ, সারানাথের ধর্মচক্র প্রবর্তন, কুশিনগরে মহা পরিনির্বান।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দেখা যাবে এক অপূর্ব দৃশ্য। সেই অপার্থিব পট ভূমিকায় দৃশ্যমান কেবল সোনালী রঙের বৌদ্ধ মূর্তি। লুম্বিনী যে পূণ্যভূমি না দেখলে বোঝা যাবেনা।
শান্তি স্তুপের পর দেখে নেওয়া যাবে মিউজিয়াম। ফুলে ভরা বাগান। মিউজিয়ামের ভিতরে রেয়েছে কাচের শো কেসে আটকানো প্রত্নতত্ব। লুম্বিনীর মাটিতে উৎ খননের সময় যা যা পাওয়া গেছে সে সব জিনিসপত্র। প্রচুর ফটোগ্রাফি। মিউজিয়ামটা ছোট হলেও খুবই আকর্ষণীয়।
চিন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, ভিয়েতনাম, নেপাল, জার্মনী, ভারত ছাড়াও অনেক দেশের তরফে বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপিত হয়েছে লুম্বিনীর মাটিতে। প্রত্যেক বুদ্ধ মঠে রয়েছে আপন আপন স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন। লুম্বিনীর মাটিতে অনেকগুলি দেশের বৌদ্ধ মঠগুলি নতূনত্বর আহ্বান রাখে। তবে পুরাতনের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরী হয়েছে নতুন বৌদ্ধ বিহারগুলি। লুম্বিনী বিশাল এলাকা একটি আয়তক্ষেত্র পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। সেখানেই বিশ্ব শান্তি স্তুপ ও মিউজিয়াম। আর দক্ষিণ প্রান্তে এক গোলাকার কেন্দ্রবিন্দুতে মায়াদেবীর মন্দির। এরই আশে পাশে রয়েছে অশোক স্তম্ভ, বৌদ্ধ মন্দির, প্রাচীন বৌদ্ধ স্তুপ ইত্যাদি লুম্বিনীর ভূগর্বস্থ উৎখনন করে পাওয়া গিয়েছে।
উত্তর থেকে দক্ষিণে রয়ে গেছে একটি স্বচ্ছ জলের ধারা। নাম সেন্ট্রাল ক্যানেল। এর পূর্ব পশ্চিম কোণে পৃথিবীর সব বৌদ্ধ বিহারগুলি। একদিকে ইষ্ট মনাষ্টিক জোন, অন্যদিকে ওয়েষ্ট মনাষ্টিক জোন।
পশ্চিম দিকের রাস্তাটা দিয়ে গেলে সেন্ট্রাল ক্যানেল পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাম দিকে কোরিয়ো এবং ডান দিকে চিনে বৌদ্ধ বিহার মুখোমুখি। ডান দিকে উঁচু পাথরের উপর হি -য়েন সাং এর সুন্দর মূর্তি দেখবার মত। পরনে পরিব্রাজকের পোশাক।
এবার সোজাসুজি পথ ধরে এগিয়ে সামনে পড়বে এক সচ্ছ সরোবর। ফুটে আছে গোলাপী পদ্ম।
এবার দেখে নেওয়া যাবে নেপালের বৌদ্ধ বিহারগুলি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। অন্য দেশের মনাস্ট্রিগুলিও অসাধারণ। শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মনাস্ট্রি মন ভরে যাবে। এবার মহাবোধি সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, লুম্বিনী সেন্টার।
বিহারের ভিতরের দেওয়াল জুড়ে লুম্বিনীতে জন্ম, অনোমা নদীর তীরে সন্ন্যাস বেশ ধারন, মার বিজয়, বোদ্ধিবৃক্ষের নীচে বোধী লাভ, শ্রাবন্তীতে অঙ্গুলিমাল দস্যুর কাহিনী, রাজগৃহে উন্মত্ত হাস্তি নালগিরি দমন। সারানাথের ধর্মচক্র প্রবর্তন প্রভৃতি এবং সবশেষে কুশীনগরে মহা পরিনির্বান।
কী ভাবে পৌঁছাবেন..ঃ- হাওড়া কাঠগুদাম ট্রেনে গোরক্ষপুর। গোরক্ষপুর থেকে সোনাউলি বাসে। সোনাউলি থেকে লুম্বিনী ৩২ কিলোমিটার। কাঠমান্ডু থেকে লুম্বিনী ২৫৯ কিলোমিটার। ৭ ঘন্টা সময় লাগে পৌঁছাতে।
কোথায় থাকবেন ঃ- টাইগার প্যালেস রিসর্ট। লুম্বিনী বুদ্ধমায়া গার্ডেন হোটেল। লুম্বিনী।
লুম্বিনী বুদ্ধ গার্ডেন।
0 মন্তব্যসমূহ