চৈতন্যদেবের রামকেলি বা গুপ্তবৃন্দাবন ঃ-
রামকেলি আজও চৈতন্যময়।
বরাহনগর প্রামাণিক ঘাট রোড সোজা হাঁটলে দেখা যাবে একটি বোর্ডে লেখা দেখতে পাওয়া যাবে 'কাঁথাধারী আশ্রম' এখানে শ্রী চৈতন্যদেব কাটিয়ে ছিলেন একটি রাত। যাবার সময় ফেলে গিয়েছিলেন নিজের গাঁয়ের কাঁথাখান। কাছেই পাঠবাড়ি। যেখানে মহাপ্রভুকে ভাগবত পাঠ ও ব্যখ্যা করে শুনিয়েছিলেন রঘুনাথ উপাধ্যায়। তাঁর পাঠ ও ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হয়ে মাহপ্রভূ দিলেন
' ভাগবতাচর্য্য' উপাধি।
এই হচ্ছে রামকেলি গ্রাম। মালদহ থেকে গৌড় যাওয়ার পথে এই রামকেলি। এই গ্রামে বাস করতেন সনাতন, রূপ আর জীব গোস্বামী। বৈষ্ণবদের এক অসাধারণ তীর্থক্ষেত্র হ'ল এই রামকেলি।
রূপ - সনাতনের প্রকৃত নাম ছিল না। নাম দেওয়া হয় অমর, সন্তোষ। এঁদের ছিল আর এক ভাই - বল্লভ। এদের বাড়ি ছিল নৈহাটিতে। সেখান থেকে ভাগ্যের ফেরে এঁদের ঠাঁই হয়েছিল বর্ধমানের মাধাইপুরে মামা বাড়িতে। তিন ভাই-ই চোস্ত হয়ে উঠেছিলেন পড়াশুনায়। সেই সময় গৌড় রাজত্ব করছে হুশেন শাহ। সম্রাটের কাছে পৌছাল তিন ভাইয়ের কথা। হুশেন শাহ ডেকে পাঠালেন তাঁর দরবারে। সম্রাট তাঁদের সাথে কথা বলে খুবই মুগ্ধ হলেন।
অমর আর সন্তোষ বহাল হলো রাজ কাজে। অমর সম্রাটের প্রধান সচীব নিযুক্ত হলেন দাবির খান নামে। রাজকাজের সাথে সাথে চলল পড়াশুনা, শাস্ত্র চর্চা। যা ছিল এদের রক্তে। দুই ভাইয়ের নাম লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লো। নবদ্বীপের পন্ডিতরা আসা ধরলেন তাঁদের কাছে। পন্ডিতরা জানালেন মহাপ্রভূ শ্রীচৈতন্যদেবের কথা। সব শুনে ওঁদের মন ব্যকুল হয়ে পড়ল মহাপ্রভূকে দেখার জন্য। শ্রী চৈতন্যদেব তখন নীলাচলে অর্থাৎ পুরী জগন্নাথে। একটি চিঠি দিলেন অমর সন্তোষ। মহাপ্রভূর উত্তর এলো। তিনি বল্লেন " মন ভগবতে ফেলে রাখ" এবং এও বল্লেন," সন্তোষের নাম রূপ আর অমরের নাম সনতন।" দুই ভাই - ই মহাপ্রভূর নামে আবিষ্ট। একদিন মহাপ্রভূ এলেন রামকেলিতে। ১৫১৫ সালের জুন মাস নাগাদ। এক অতি সাধারণ বেশে এলেন রূপ আর সনাতন এবং লুটিয়ে পড়লেন মহাপ্রভূর শ্রী চরণে। বল্লেন, "আমাদের উদ্ধার করো প্রভূ "। মহাপ্রভূ বল্লেন শিঘ্রই সংসার বন্ধন ঘুচে যাবে তোমাদের। মন সব কেমন হয়ে গেল। কাজ কাম একদম ভালো লাগেনা তাদের। হুশেন শাহ খবর পেয়ে গেলন। একদিন সম্রাট ওদের দুই ভাইকে ডেকে বল্লেন," কলিঙ্গ বিজয়ে বেরবো আমি। তোমরা আমার সাথে যাবে।"
সনাতন কলিঙ্গ বিজয়ে যেতে রাজী নহে।
বল্লেন, " সম্রাটের ধর্ম বিরোধী ধ্বংসাত্মক কাজের সঙ্গি হতে রাজী নহে। হুশেন শাহের সন্দেহ তীব্র হলো। সনাতনকে বন্দি করে গৌড়ের কারাগারে নিক্ষেপ করলেন।
কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় খুঁজতে লাগলেন। হাবু শেখকে বিশাল অর্থের বিনিময়ে কারাগার থেকে বাইরে এসে পালিয়ে গেলেন। হুশেন শাহ সনাতনের খোঁজের নির্দশ দিলেন।
সনাতন পালিয়ে পৌঁছালেন কাশীধামে। মহাপ্রভু এখানই আছেন। খোঁজাখুঁজির পর মিললো শ্রী চন্দ্র শেখরের বাড়িতে চৈতন্যদেবের। মহাপ্রভূ টানা দু মাস ধরে সনাতনকে উপদেশ দিলেন দশশ্বমেধ ঘাটে বসে।
মহাপ্রভূ যখন রামকেলিতে আসেন তখন শ্রী জীবের সাথে সাক্ষাৎ হয়। পরে শ্রীজীব গোস্বামী হয়েছিলেন বৃন্দাবন বাসী।
শ্রী জীব পঁচিশটি বই লিখেছেন। রামকেলি গ্রামের প্রবেশ মুখে রূপ সনাতন ও মদনমোহন মন্দির। এখানেই দেখা যাবে কদম আর তমালের জোড়া গাছ। এই গাছের তলায় বসে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূ বিশ্রাম করতেন। একটি পাথরে আছে মহাপ্রভূর পদচিহ্ন। আছে রূপ সনাতনের বাড়ি। রূপ সাগর দিঘী। জীবের তৈরী শ্যামকূন্ড, রাধাকূন্ড, ললিতাকূন্ড আর বিশখাকূন্ড। এই সব কূন্ডের জল বৈষ্ণবদের কাছে খুব পবিত্র। সেই কারণে রামকেলির আরেক নাম গুপ্ত বৃন্দাবন। জৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তির দিন রামকেলিতে মহাপ্রভূর আগমণ স্মরণে এক মেলা বসে। একে বলা হয় চৈতন্য স্মরণোৎসব। এই মেলায় এক সময় বৈষ্ণবদের সহচরি পছন্দ করে কন্ঠি বদল করা। এবার গন্তব্য গৌড়।
কী ভাবে যাবেন ঃ গৌড় এক্সপ্রেসে মালদহ। এখান থেকে রামকেলি। বাসেও যাওয়া যায়
0 মন্তব্যসমূহ