শিমূলতলা-মধুপুর-দেওঘর বাঙালীর অতীতের ঝলক দেখতে চলুন ঃ
ঝাড়খন্ডের সীমানায় সাঁওতাল পরগনাস্থিত দেওঘর, শিমূলতলা ও মধুপুর জানা যায় বাঙালীর সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কিছু ঝলক।
প্রথম গন্তব্য ছিল দেওঘর। জসিডি জংশনে নেমে অটো ভাড়া নিয়ে আধ ঘন্টায় দেওঘর পৌছানো যাবে। দেওঘরের মূল আকর্ষণ বৈদ্যনাথ ধাম, তবে হতাশাজনক ভাবে এই ধর্মীয় স্থানে পান্ডাদের থেকে সাবধান। এছাড়া রয়েছে ত্রিকূট পাহাড়, তপোবন আর নওলখা মন্দির। বেশ সুন্দর প্রত্যেকটিই। বিকেল চারটের আগে গেলে ত্রিকূট পাহাড়ের রোপওয়ে তে চড়ে পাহাড়ে উঠতে উঠতে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা চট্ করে ভোলবার নয়। নওলখা মন্দির এক উত্তম স্থাপত্যের নিদর্শন। মন্দিরের সামনের রাস্তায় সস্তায় নানা সাইজের উৎকৃষ্ট লোহার হাতা, খুন্তি, কড়াই, হামান দিস্তা ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়াও দেওঘরের দুগ্ধজাত মিষ্টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পেড়া, রাবড়ি, ছানার মুড়কি, কাঁচা গোল্লা, রাজভোগ ইত্যাদি মারাত্মক খেতে। প্রতিটি মিষ্টিই স্বাদে গন্ধে অপূর্ব। দেওঘরের মার্কেটে নানা রকম শীতবস্ত্র সস্তায় মেলে। বাজারের মধ্যে “পেড়া গলি” -তে গেলে গরম গরম পেড়া বানানো হচ্ছে দেখতে পাওয়া যায় এবং হাত পাতলে দোকানিরা গরম গরম পেড়ার মাখা চাখতেও দেয়। তবে সবচেয়ে ভাল পেড়া সম্ভবত পাওয়া যায় ত্রিকূট পাহাড় যাওয়ার রাস্তার দোকান দুর্গায়। এছাড়া মন্ডলের পেড়াও নামকরা। মূল দেওঘর শহর বর্তমানে ঘিঞ্জি হয়ে গেলেও শহর থেকে একটু বেরোলেই চারপাশে ধু ধু ফাঁকা মাঠ, পাহাড়, নদী আর সবুজ গাছপালা মন ভাল করে দেয়।
, শিমূলতলা যাওয়ার পথে হলদী ফলস বা স্থানীয়দের ভাষায় ঝাজোয়া ফলস। খুব সুন্দর। পাহাড়ী হলদী নদী, বন জঙ্গল পাহাড় ভেদ করে বয়ে চলেছে। রামকৃষ্ণ-সারদা মঠ, লাট্টু পাহাড় আর রাজবাড়ী দেখে যখন শিমুলতলি। বড় ভাল জায়গা। “টিলা টিলা পাহাড়, আর ভিলা ভিলা শিমূলতলা”- এখানে সময় যেন থমকে রয়েছে আজ থেকে এক শতাব্দী পূর্বে, সেই ইংরেজ আমলে। চারপাশ ফাঁকা, দূরে রুক্ষ অনুচ্চ টিলা, মাঝে মাঝে সবুজের হাতছানি আর কিছুদূর হেঁটে গেলেই একটা করে সেকালের জমিদারদের কুঠিবাড়ী। কোনটার বয়স একশো, দেড়শো বা দুশো। রথিনরা এরকমই একটা কুঠিতে উঠলো। যশোদা ধাম। সারিয়ে সুরিয়ে বর্তমানে এটি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। নয় নয় করে ছিল অন্তত সাড়ে পাঁচশো কুঠি। কিন্তু আজ আর সেই দিন নেই। বাঙালি আর আসেনা শিমূলতলায় সেভাবে। কুঠিবাড়ী গুলির অধিকাংশই হয় ভেঙে পড়েছে নয় বিক্রি হয়ে গেছে। আজকের এই ভাঙাচোরা বাড়ীগুলির ধ্বংসাবশেষ বহন করছে আমাদের বাঙালী জাতির এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। খাবার দাবারের মধ্যে বলতেই হয় সন্ধের ক্যাম্প ফায়ারের চিকেন রোস্ট আর রাতে পাচকের হাতে রাঁধা গরম গরম বন মুরগীর ঝোল ভাতের কথা। সে এক অসাধারণ স্বাদ। এছাড়া আদিবাসীদের বানানো মহুয়।
‘প্রফেসর শঙ্কু’ খ্যাত গিরিডির উস্রী ফলস দেখে শেষ গন্তব্য ছিল বাঙালী চেঞ্জার বাবুদের আদি পীঠস্থান মধুপুর। রথিনরা উঠলো মুকুল বোসের ‘লীলা কমল’ গেস্ট হাউসে। বাহান্ন বিঘা অঞ্চলটি এতই সুন্দর ছিল যে একে বলা হত – “ভারতের হল্যান্ড”।
রকমারী বাহারী ফুল আর গোলাপ বাগান গুলিও সেভাবে নেই আর। সব মিলিয়ে মধুপুরের সেই চার্ম টা কোথাও যেন মিসিং। তবে ওল্ড মধুপুর শহরটা পায়ে হেঁটে বা টোটোয় চেপে ঘুরতে এখনো ভালই লাগবে। রাস্তার ধারে পর পর দেখতে পাওয়া যায় পুরোনো কুঠিবাড়ী গুলি।
কুঠি সোনার বাংলা, জাহাজ বাড়ী, শেঠদের কুঠি, হরেন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী স্বস্তিকা, লাল কুঠি ও সংলগ্ন মন্দির এবং মধুপুর চার্চ ঘুরে দেখা যেতে পারে। এছাড়াও দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো পাথরোল কালীবাড়ি। বাজারের মধ্যে হঠাৎ দেখা যাবে সিমেন্টে বাঁধানো এক বিরাট পাতকুয়ো। নাম ডালমিয়া কূপ। জানা গেল এর জল নাকি হজমের জন্য এতই ভাল ছিল যে এককালে বড় বড় জালায় ভরে জনতা এক্সপ্রেসে চাপিয়ে কোলকাতায় সেই জল সরবরাহ করা হত। যাকগে, এখন আর সেই দিন নেই, ডালমিয়া কূপের জল এখন আর আসেনা।
প্রচুর বাঙালী এখানে। এদের পূর্বপুরুষরা মূলত রেলের চাকরির সুবাদে মধুপুরে এসেছিলেন এবং অনেকেই আর ফিরে যাননি। সকলের কথাতেই এক অভিমানী সুর, বাঙালী আজ পশ্চিম থেকে মুখ ফিরিয়েছে, ‘চেঞ্জার বাবু’ রা এখন ‘Changed’, আর আসেননা সেরকম কেউ।
ভোর রাতে মধুপুরে প্রবল ঠান্ডা পড়ে এখনো। কান পাতলে শোনা যায় ট্রেনের লম্ব ভোঁ।মধুপুর দাঁড়িয়ে থাকে মধুপুরেই।।
কিভাবে যাবেন ঃ
যাওয়ার ট্রেন পূর্বা এক্সপ্রেস, হাওড়া থেকে জসেডি।
0 মন্তব্যসমূহ